তখন মইরা গেলে কি আর এই সুন্দর জীবন পাইতাম! কাজ-কাম করতে পারি, আত্মহত্যার কথা কখনো মাথায় আসে নাই। এখন ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়া আছি, কত সুখে আছি।
কথাগুলো বলছিলেন মাকসুদা বেগম। বয়স তার ৪৫-এর মতো। এই জীবনের উপর দিয়ে কত ঝড়-ঝাপটাই না বয়ে গেছে। কিন্তু হাল ছাড়েননি কখনো, দক্ষ হাতে সামলেছেন সব। তাই এই বয়সে এসে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামী দিনগুলোর কথা বলে যান অকপটে।
চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয় মাকসুদা বেগমের। টানাটানির সংসার। তখন থেকেই শুরু হয় তার সংগ্রাম। হাতের কাজ জানতেন। টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করে সংসারের নানান প্রয়োজন মিটিয়ে নিতেন। একসময় এই টানাটানির সংসারেও সতীন নিয়ে হাজির হয় তার স্বামী। সংসার দুইভাগ হয়। সেই সাথে শুরু হয় তার উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
ঘরে সতীন এলেও টুকটাক কাজ করে স্বামীর সংসার করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু স্বামী ছেলেমেয়েদের খোঁজ-খবর নেয় না, খরচা দেয় না। উপরন্তু সতীনের বিবাদ। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যেতে থাকে। পাঁচ বছর চেষ্টার পরও যখন দেখলেন, এভাবে আর টিকে থাকা যায় না, তখন স্বেচ্ছায় বিচ্ছেদ চাইলেন স্বামীর কাছে। স্বামী রাজি হলেন। তবে শর্ত দিলেন, ছেলেমেয়েদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। মাকসুদা বেগম শর্ত মেনে নিলেন। সবকিছু দেখে-শুনে তার বাবা সমর্থন করেন তাকে। এই দুঃসময়ে মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ান তিনি। বাবা নিজেই খুব কষ্টে জীবন যাপন করেন। তবুও মেয়েকে তার বাড়ির একটি কক্ষে মাথা গোঁজার ঠাঁই দেন।
তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে শুরু হয় টিকে থাকার লড়াই। মানুষের বাড়িতে কাজ করে, সেলাই কাজ করে সংগ্রাম চলতে থাকে। কত কী না করেছেন তিনি! স্পিনিং মিলে কাজ করেছেন, মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কাজ করেছেন। বড় মেয়েকে সাথে নিয়ে মানুষের বাড়িতে গাইল-ছিয়াতে চাল কুটেছেন। এমনও দিন গিয়েছে, একদিনে দশ কেজি চালও কুটেছেন মা-মেয়ে মিলে! কাজ করেছেন বিভিন্ন মেসে। ছাত্রদের হোস্টেলেও। এখনো একাধিক মেসের বাবুর্চি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন প্রাণোচ্ছল মাকসুদা বেগম।
এই বিশ-পঁচিশ বছরের সংগ্রামী জীবনে কত অভিজ্ঞতারই না সম্মুখীন হয়েছেন! আত্মীয়-স্বজনেরা দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছে, চেষ্টাও করেছে বহুবার। কিন্তু তিনি রাজি হননি। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামটা নিজেকেই করতে হয়, কারো ঘাড়ে চেপে বসে নয়।
এই দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে কখনো কি কোন হতাশা কাজ করেনি বা হার মেনে আত্মহত্যার মতো কাজ করার চিন্তা কি কখনো মাথায় এসেছে…? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলতে থাকেন, “তখন মইরা গেলে কি আর এই সুন্দর জীবন পাইতাম! কাজ-কাম করতে পারি, আত্মহত্যার কথা কখনো মাথায় আসে নাই। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়া আছি, কত সুখে আছি।”
ছেলে ও দুই মেয়েকে ভালো পরিবারে বিয়ে দিয়েছেন। তারা সুখেই আছে। ছেলে রাজমিস্ত্রির কাজ করে। ছেলে রুজি-রোজগার করার পরও এখনো কেন এই বয়সে কাজ করতে চান? জবাবে তিনি হেসে বলেন :
কারো কাছে হাত পাততে, নির্ভরশীল হয়ে থাকতে লজ্জা লাগে। এমনকি নিজের পেটে ধরা ছেলের কাছেও।
এখনো সমানতালে পরিশ্রম করে যেতে পারেন। কাজকেও ভালোবাসেন। তাই এখনই ছেলে-মেয়েদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে চান না। ছেলে-মেয়েদের উপর নির্ভরশীল হওয়ার পরিবর্তে তাদেরকে নানানভাবে সহায়তা করার কথা সব সময় চিন্তা করেন।
নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে মাকসুদা বেগম একজন অপরাজেয় সৈনিক। মাকসুদা বেগমের যে আত্মমর্যাদাবোধ আর সংগ্রামী চেতনা, তা আজকালকার অনেক বিএ-এমএ পাশ করা অফিসার নারীর মধ্যেও বিরল। মাকসুদা বেগম আমাদের পরিশ্রম করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করেন। ‘নারী অঙ্গন’-এর পক্ষ থেকে তাকেসহ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে লড়াইরত সকল সংগ্রামী নারীদের জন্য লাল সালাম।
মাকসুদা বেগমকে দেখে উইলিয়াম ব্লেকের একটা কথা মনে পড়ে যায়, “So if all do their duty they need not fear harm.” অর্থাৎ যারা তাদের দায়িত্ব পালনে সঠিক, তারা কোন কিছুতে ভয় পায় না।