বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪
Homeপ্রস্তাবনানারী অঙ্গনের ১২ দফা প্রস্তাবনা

নারী অঙ্গনের ১২ দফা প্রস্তাবনা

দার্শনিক জন লক (১৬৩২-১৭০৪) সেই ১৭ শতকেই অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় চারশত বছর আগে জানান দিয়ে গিয়েছেন… মানুষের ৩ টি প্রাকৃতিক তথা জন্মগত অধিকার রয়েছে : জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তি (Life, Liberty and Property) এবং নাগরিকদের এইসব জন্মগতভাবে পাওয়া অধিকারের সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্র নৈতিকভাবে বাধ্য। নিজেদের সভ্য বলে দাবি করা পুঁজিবাদী দেশগুলোও বহু আগেই তাদের নাগরিকদের জন্মগতভাবে পাওয়া এসব অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে এবং বাস্তব জীবনে কার্যকর করেছে।

১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক এই স্বাধীন, সার্বভৌম, গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ঘটানো হয়েছিল সকল প্রকার অসমতা, অন্যায্যতা, বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে’। (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র)

সংবিধানেও অঙ্গীকার করা হয়েছে, “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।” (২৭ নম্বর অনুচ্ছেদ)

সংবিধানের তৃতীয় ভাগের (মৌলিক অধিকার) ২৬ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।”

প্রায় ৫২ বছর আগে বাংলাদেশ নামক দেশটির জন্ম হলেও, বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক নাগরিক নারীদের বেশিরভাগেরই ‘জীবন’ তাদের নিজেদের কাছে নেই; বাপ, ভাই, স্বামী, ছেলে সন্তানের কাছে বন্ধক দেওয়া।

তাদের ‘স্বাধীনতা’ আজীবনের জন্য বিনে পয়সায় মিয়াদী নিয়ে নিয়েছে পিতৃতন্ত্র, পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা, পিতৃতন্ত্রের এজেন্টরা।

আর ‘সম্পত্তি’? সেটাও প্রায় নাই বললেই চলে। তাদের নামে থাকা বেশিরভাগ সম্পত্তিই সাধারণত জামাইরা আইনগত ঝামেলা থেকে বাঁচতে বউদের নামে রেখে দিয়েছে কেবল। পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে কিংবা নিজেদের অর্জিত নয়। তাই সেসবের প্রকৃত মালিক এবং খরচের অধিকারীও তারা নন।

একটা দেশের প্রায় অর্ধেক নাগরিককে কখনো আইনগতভাবে, কখনো প্রায়োগিকভাবে জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের প্রকৃত বিকাশ যেমন সম্ভব নয়, তেমনি একটা নূন্যতম পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবেও গড়ে তোলা সম্ভব নয়। অথচ স্বাধীনতার পর ৫২ বছর পার হয়ে গিয়েছে।

তাই নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য, অন্যায্যতা, অসমতা কিছুটা হলেও দূর করতে ‘নারী অঙ্গন’-এর এই ১২ দফা প্রস্তাবনা।

২০২২ সালের ৮ মার্চ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে দেশের সকল স্তরের বোনদের সাথে কানেক্টিভিটি গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নারী অঙ্গনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই সময়টাতে আপনাদের অকুণ্ঠ সমর্থন, সহযোগিতা এবং ভালোবাসা পেয়েছি আমরা। নারী অঙ্গনের সূচনা দিবস এবং আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস উপলক্ষে নারী অঙ্গনের সকল বন্ধু, সমর্থক, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং সমালোচকদের নারী অঙ্গনের তরফ থেকে শুভেচ্ছা।

সামনের দিনে নারী অঙ্গন যে বিষয়গুলো নিয়ে বড় পরিসরে আওয়াজ তুলতে চায়, সেগুলো ‘১২ দফা প্রস্তাবনা’ আকারে এখানে প্রকাশ করা হলো।

১. পৈতৃক সম্পত্তিতে সমান অধিকারের আইন প্রবর্তন

সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষের জন্য পিতা-মাতার সম্পত্তিতে সমানাধিকারের আইন প্রণয়ন  করতে হবে। এবং সেই আইন বাস্তবায়নে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের দিয়ে, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ব্যবহার করে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে, জনমত তৈরি করতে হবে।

২. নারী ও পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান অন্যায্য বেতন ও মজুরী বৈষম্য দূরীকরণ

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারী ও পুরুষ কর্মীর মধ্যে বেতন বৈষম্য এবং কৃষি শিল্প, নির্মাণ শিল্প, গার্মেন্টস শিল্পসহ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পখাতে নিয়োজিত নারী ও পুরুষ  শ্রমিকদের মধ্যে বিদ্যমান মজুরি বৈষম্য দূর করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত নারী কর্মীদের এবং শিল্প কারখানার শ্রমিকদের পূর্ণ বেতন-ভাতাসহ ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে হবে। গর্ভকালে এবং প্রসূতিকালে কোন নারী কর্মী এবং শ্রমিককে ছাঁটাই করলে সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচনা করতে হবে।

৩. গৃহ ব্যবস্থাপনার কাজের আর্থিক স্বীকৃতি

গৃহিণী বোনরা ঘরের যাবতীয় কাজ এবং সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন বলেই তাদের স্বামীরা অর্থাৎ আমাদের ভাইয়েরা ঘরের বাইরে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন, অর্থ উপার্জন করতে পারেন। গৃহিণী বোনরা অনেকেই সংসারে সারা দিন-রাত খেটেও, অবদান রেখেও প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে সারা জীবন অতিবাহিত করেন। পান থেকে চুন খসলেই আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। এই বুঝি স্বামী-গৃহ থেকে উচ্ছেদ হবেন। অনেক স্বামীও আমাদের গৃহিণী বোনদের এই অবস্থার সুযোগ নেন।

খবরের কাগজে সারাদেশে ঘটে চলা ঘটনার খুব সামান্যই খবর আকারে আসে। তারপরও আমরা আমাদের বোনদের, বিশেষ করে গৃহিণী বোনদের উপর স্বামীর, স্বামীর পরিবারের সদস্যদের পাশবিক নির্যাতনের, হ**ত্যা**কা**ণ্ডে**র, আ**ত্ম**হ**ত্যা**র যেসব খবর দেখি প্রতিদিন, সেসব আতঙ্কিত করার মতোই বিবেকবান প্রতিটি মানুষকে।

তাই গৃহিণী বোনদের বিচ্ছেদের পর তারা যেন বিয়ের পর স্বামীর উপার্জিত সম্পত্তির অর্ধেক অংশীদার হতে পারেন এমন আইন প্রণয়ন করতে হবে। এই আইন একদিকে যেমন গৃহিণী বোনদের সংসার জীবনকে নিরাপদ করবে, নিশ্চিত করবে; অন্যদিকে বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও তাদের আর্থিক নিরাপত্তা দিবে।

৪. অভিবাসী নারী শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না করা পর্যন্ত বিদেশে নারী শ্রমিক প্রেরণ স্থগিতকরণ

প্রবাসে প্রতি ৩ দিনে ১ জন নারী শ্রমিকের মৃ**ত্যু ঘটছে। প্রবাসে নারী শ্রমিকদের মজুরি বঞ্চনা, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, পাশবিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, হ**ত্যা, আ**ত্ম**হ**ত্যা করতে বাধ্য করা ইত্যাদি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তাই প্রবাসে শতভাগ নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না করা পর্যন্ত নারী শ্রমিক পাঠানো স্থগিত রাখতে হবে। এবং বিদেশ থেকে আসা মৃতদেহ পুনরায় ময়নাতদন্ত করে মৃ**ত্যু**র প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করে দোষীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

৫. সরকারি উদ্যোগে বেবি কেয়ার সেন্টার স্থাপন

কারখানায় কারখানায়, উপজেলা, জেলা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় শ্রমিক, স্থান, দূরত্ব, জনসংখ্যা বিবেচনায় সরকারি উদ্যোগে দক্ষ জনবল দিয়ে আধুনিক মানসম্পন্ন বেবি কেয়ার সেন্টার স্থাপন করতে হবে।

৬. সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ

অনলাইনে নারী উদ্যোক্তা ও অন্য নারীদের সম্পর্কে অশ্লীল মন্তব্য ও হেনস্তাকারীদের বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

৭. ছাত্রী হলগুলোতে থাকা প্রচলিত সান্ধ্য-আইন বাতিলকরণ

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোতে যেখানে আঠারো বছরের অধিক বয়সী ছাত্রীরা থাকে, সেসব হলে প্রচলিত বিদ্যমান সান্ধ্য-আইন বাতিল করতে হবে। ছাত্র হল এবং ছাত্রী হলে কোন রকম বৈষম্যমূলক প্রবেশ এবং বহির্গমন বিধি-বিধান প্রবর্তন করা যাবে না।

৮. নারীদের জন্য ২৪ ঘণ্টা নিরাপদ চলাফেরার পরিবেশ নিশ্চিতকরণ

দিনরাত ২৪ ঘণ্টা নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাই নারীদের জন্য ঘরে-বাইরে সর্বত্র ২৪ ঘণ্টা নিরাপদ চলাফেলার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ‘সন্ধ্যায় মেয়েরা ঘরের বাইরে কেন?’ এমন প্রশ্ন করে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করলে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

৯. বিবাহ রেজিস্ট্রেশন আইনের পিতৃতান্ত্রিক, অবমাননাকর, বৈষম্যমূলক ধারা বাতিলকরণ

১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী যে প্রতিলিপি তৈরি করা হয়েছে, সেখানে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন অর্থাৎ নিকাহনামায় *৫ নম্বর কলামে পাত্রী ‘কন্যা কুমারী, বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্ত কি না’ জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু পাত্র তথা পুরুষের ক্ষেত্রে এরকম কিছু জানতে চাওয়া হয় না।

এবং *১৮ নম্বর কলামে জানতে চাওয়া হয় ‘স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করিয়াছে কি না’। ইসলামে ৩ ধরনের তালাকের বিধান রয়েছে, যথা : তালাক, খুলা, মুবারাত। খুলা হলো স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাকের অধিকার। যে অধিকার স্বয়ং ইসলাম স্ত্রীকে দিয়েছে, সে অধিকার পুনরায় স্বামী স্ত্রীকে দেওয়ার কে?

বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইনের এই ২ টি ধারা যে কোন নারীর জন্য যেমন অবমাননাকর, বৈষম্যমূলক, তেমনি সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে—

“সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী”

অনুচ্ছেদ ২৮ (১) “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না”

অনুচ্ছেদ ২৮ (২) “রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবে”

যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, তারও সরাসরি এবং সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। একইসাথে রাষ্ট্রের পিতৃতান্ত্রিক চরিত্রকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে। তাই বিয়ের রেজিস্ট্রেশন ফরমের এই ২ টি ধারা অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।

১০. ‘ধ**র্ষ**ণ’-এর পিতৃতান্ত্রিক, অবমাননাকর এবং বৈষম্যমূলক সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যার সংশোধনকরণ

Penal Code-1860 এর দণ্ডবিধি ৩৭৫ ধারায় ধ**র্ষ**ণ ( Rape)-এর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এইভাবে—

“যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা তার অনুমতি বা সম্মতি ব্যতিরেকে কিংবা মৃ**ত্যু বা আঘাতের ভয় দেখিয়ে সম্মতি নিয়ে অথবা যৌন সম্পর্ক স্থাপনের সম্মতির জন্য প্রতারণার মাধ্যমে নারীকে বুঝিয়েছে যে, সে তার স্ত্রী, ১৬ বছরের কম বয়স্ক নারীর সম্মতি নিয়ে বা সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে, যৌন সঙ্গম করলে তা ধ**র্ষ**ণ বলে গণ্য করা হবে।”

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ৯ (১) ধারায় ধ**র্ষ**ণে**র ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে—

“যদি কোন পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতিত ১৬ বৎসরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ১৬ বৎসরের কম বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধ**র্ষ**ণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।”

দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধ**র্ষ**ণে**র সংজ্ঞায় এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ৯ (১) ধারায় ধ**র্ষ**ণে**র ব্যাখ্যায় প্রতারণামূলক সম্মতি আদায়ের মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের উল্লেখ থাকায় অনেক সুযোগ সন্ধানী নারী পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে প্রেমিকের সাথে দীর্ঘদিন যৌন সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার পর এক পর্যায়ে প্রেমিক যদি সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চায়, তাহলে এই ধারার সুযোগ নিয়ে ‘প্রলোভন দেখিয়ে ধ**র্ষ**ণ’-এর মামলা দিয়ে হয়রানি করে থাকে। এর ফলে প্রতিবছর যে শত শত নারী ধ**র্ষ**ণে**র শিকার হয়, তাদের সাথে ঘটা ধ**র্ষ**ণে**র অপরাধও হালকা হয়ে যায়, প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। এছাড়া প্রেমিক বা অন্য কোন পুরুষ বিয়ে বা অন্য কিছুর প্রলোভন দেখালেই নারীর সাথে যৌন সম্পর্কে যাওয়া যায় বলে দেখানো হচ্ছে এখানে। এর মাধ্যমে নারীকে অবলা, নির্বোধ, লোভী প্রাণী হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, যা সকল নারীর জন্য অবমাননাকর এবং পিতৃতান্ত্রিক চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ। এক্ষেত্রে প্রতারণার মামলা হতে পারে বড়জোর এবং সেক্ষেত্রে এই সুযোগ নারী-পুরুষ উভয়েরই থাকা উচিত।

আরো একটি কারণে ধ**র্ষ**ণে**র এই সংজ্ঞা এবং ব্যাখ্যাকে আমরা বৈষম্যমূলক, অগ্রহণযোগ্য এবং পিতৃতান্ত্রিক বলে মনে করি। সেটি হলো, এখানে শুধু পুরুষ কর্তৃক নারীর যৌন নির্যাতনের কথা বলা হয়েছে, অথচ বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা প্রায়ই খবরের কাগজের মাধ্যমে জানতে পারি, শতকরা ৫ ভাগ পুরুষ পুরুষ কর্তৃক ধ**র্ষ**ণে**র শিকার হয়। ধ**র্ষ**ণে**র এই সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যায় নারী কর্তৃক পুরুষ, পুরুষ কর্তৃক পুরুষ, নারী কর্তৃক নারী বা ট্রান্সজেন্ডার কর্তৃক ট্রান্সজেন্ডারের যৌন নির্যাতন বা ধ**র্ষ**ণ**কে অস্বীকার করা হয়েছে। তাই আইনের উপরিউক্ত ধারার ধ**র্ষ**ণে**র সংজ্ঞা এবং ব্যাখ্যা থেকে নারীর জন্য অবমাননাকর এই পিতৃতান্ত্রিক এবং বৈষম্যমূলক অংশের প্রত্যাহার বা সংশোধন অপরিহার্য বলে মনে করি।

১১. সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপদ শিক্ষাজীবন নিশ্চিতকরণ

সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকা ছাত্র হলগুলো একশো ভাগ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ও তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করতে হবে, সিট বরাদ্দ করতে হবে। যাতে কোন ছাত্র সংগঠন বা গোষ্ঠী ছাত্রদের জিম্মি করতে না পারে। জোরপূর্বক কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করতে না পারে কিংবা জিম্মি করে কোন প্রকার শারীরিক, মানসিক নিপীড়ন করতে না পারে। কেউ এই ধরনের ঘটনা ঘটালে তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত করে দোষীদের হল থেকে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে আইনগত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরও কর্তব্যে অবহেলার জন্য শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

মাদ্রাসাগুলোতেও অব্যাহতভাবে ঘটে চলা হ**ত্যা, ‘আ**ত্ম**হ**ত্যা’, নির্যাতন বন্ধে টাস্কফোর্স গঠন করে প্রতিকারের উপায় খুঁজে বের করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

১২. সাধারণ শিক্ষা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় পোশাককে ইউনিফর্ম হিসেবে নির্ধারণ নিষিদ্ধকরণ

ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হয় এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সাধারণ শিক্ষা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারিত পোশাককে ইউনিফর্ম হিসেবে নির্ধারণ করা যাবে না। একই প্রতিষ্ঠানে এপ্রোন ইউনিফর্ম দিলে ছাত্র এবং ছাত্রী উভয়কেই দিতে হবে। আলাদা করে ছাত্র অথবা ছাত্রীকে দেয়া যাবে না। তবে কেউ স্বেচ্ছায় নিজ নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নির্ধারিত পোশাক পরিধান করতে চাইলে সেখানে কোন রকম বাধা প্রদান করা যাবে না। অর্থাৎ কাউকে ধর্মীয় পোশাক পরিধান করতে যেমন বাধ্য করা যাবে না, তেমনি বাধাও প্রদান করা যাবে না। তবে পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য মুখমণ্ডল অনাবৃত রাখার বিধান করা যেতে পারে।


৮ মার্চ ২০২৩, বুধবার
‘নারী অঙ্গন’ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাম্প্রতিকা