শুক্রবার, ডিসেম্বর ২০, ২০২৪
Homeহোমমেকার“তুমি তো কেবল দুইটা কাজই পারো— খাইতে আর ঘুমাইতে”

“তুমি তো কেবল দুইটা কাজই পারো— খাইতে আর ঘুমাইতে”

“তুমি তো কেবল দুইটা কাজই পারো— খাইতে আর ঘুমাইতে।”

দীর্ঘ ছুটিতে ঢাকায় প্রাইভেট চাকরি করা পার্টনারের কাছে গেলে তার কাছ থেকে কোন কারণ ছাড়াই এই কথা শুনতে হয়েছে ঢাকার বাইরে কর্মরত পরিচিত এক ক্যাডার কর্মকর্তাকে। যদিও ছুটিতে ঢাকায় গেলে কখনো বরের সাথে একই বাসায় থাকা দেবরকে দিয়ে, কখনো নিজে থেকে বাজারে গিয়ে পছন্দ মতো বাজার করতো। সকালে একসাথে বসে নাস্তা করিয়ে বরকে অফিসে পাঠাতো। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে আসার আগেই রাতের রান্না সেরে সন্ধ্যার নাস্তা তৈরি করে রাখতো। ঘরের সব কাজ গুছিয়ে রাখতো। অর্থ উপার্জন না করা উচ্চ শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত বোনদের, সবাইকে বলবো না, অনেককেই স্বামীর ঘরে কেমন সম্মান আর আদরের জীবন যাপন করতে হয়, এ থেকেই বুঝা যায়।

অনেক পুরুষ তো বটেই, ঘরে এবং ঘরের বাইরে কাজ করে যেসব নারী অর্থ উপার্জন করেন অর্থাৎ চাকরি, ব্যবসা ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত আছেন, তারা অনেকেই গৃহিণী বোনদের কম গুরুত্ব দেন। রাষ্ট্রেরও তেমন কোন মাথাব্যথা দেখা যায় না গৃহিণী বোনদের আর্থিক নিরাপত্তা, ঘরের কাজের আর্থিক স্বীকৃতি, জীবনের নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে উদ্যোগ, পরিকল্পনার ব্যাপারে।

নারী অঙ্গন বিভিন্ন বই এবং বিষয় নিয়ে প্রতি ১৫ দিন অন্তর অন্তর বন্ধুদের সাথে নিয়মিত আড্ডা দেয়। আমাদের গত ২৭ জানুয়ারির আড্ডা ছিল ‘গৃহিণী ও গৃহ ব্যবস্থাপনার কাজ’কে নারী অঙ্গন কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, তা নিয়ে। আমরা গৃহিণী অর্থাৎ গৃহ ব্যবস্থাপক বন্ধুদের ভাবনা, সংগ্রাম, স্বপ্নের কথা শুনেছি সেদিন। পাশাপাশি গৃহিণী এবং গৃহ ব্যবস্থাপনার কাজকে নারী অঙ্গনের অন্য পেশায় নিয়োজিত থাকা বন্ধুরা কীভাবে দেখছেন, সেটাও জানার চেষ্টা করেছি।

আমরা অনুসন্ধান করে দেখেছি, নারীরা কতগুলো বাস্তবতার কারণে সরাসরি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত না হয়ে কখনো স্বেচ্ছায় গৃহিণী হোন, আবার কখনো হতে বাধ্য হোন।

১. আমাদের অনেক উচ্চ শিক্ষিত বোনরা বিয়ের আগে স্বামী এবং শ্বশুর পক্ষের লোকদের সাথে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে ঘরের কাজ সম্পাদনা, পরিচালনা, সন্তান লালন-পালন এবং পরিবারের সদস্যদের যথাযথ টেক-কেয়ার যাতে করতে পারেন, সেজন্য গৃহিণী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

২. বিয়ের পরও ঘরের বাইরে কাজ করতে চান। তবে স্বামী এবং তার পরিবারের সদস্যদের অসম্মতির জন্য সংসার টেকাতে গৃহিণীর জীবন বেছে নেন আমাদের অনেক বোনরা।

৩. মনের মতো বেতন এবং কাজ না পাওয়ায় আমাদের অনেক বোন গৃহিণীর জীবন বেছে নেন।

৪. অনেক বোন সংসার দেখাশোনা, সন্তান লালন-পালন এবং চাকরি একসাথে করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যান। এরকম অবস্থায় কখনো কখনো স্বামী, শ্বশুরবাড়ির সহযোগিতার অভাবে, চাপে পড়ে এবং সংসার, সন্তানের মুখ চেয়ে চাকরি ছেড়ে গৃহিণীর জীবন বেছে নেন।

৫. সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্তান লালন-পালনের আধুনিক, নির্ভরযোগ্য ও সহজলভ্য ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় অনেক বোন কর্মজীবীর জীবন বেছে নিতে পারেন না।

৬. কেউ কেউ আবার মনে করেন, ঘরের বাইরে কাজ করা নারীদের উচিত না। পুরুষ বাইরে থেকে উপার্জন করে নিয়ে আসবে আর সন্তান লালন-পালন থেকে ঘরের সার্বিক কাজ করবে নারীরাই। এজন্য অনেক বোনরা গৃহিণীর জীবন বেছে নেন।

৭. স্বামী-স্ত্রী দুজনের কর্মস্থলের দূরত্বের জন্য কেউ কেউ কাজ ছেড়ে দিয়ে গৃহিণীর জীবন বেছে নেন।

৮. কোন কোন বোন বাইরে গিয়ে চাকরি না করলেও ঘরে থেকেই টুকিটাকি কাজের মাধ্যমে ভালো উপার্জন করছেন এবং সংসারে অর্থনৈতিক অবদান রাখছেন।

আমাদের বোনেরা গৃহ ব্যবস্থাপনার কাজকে যেই কারণেই গ্রহণ করুন না কেন, গৃহ ব্যবস্থাপনার কাজকে নারী অঙ্গন মোটেও অপ্রয়োজনীয়, গুরুত্বহীন, অর্থহীন, অসম্মানজনক বলে মনে করে না কিছুতেই। যেটা আমাদের সমাজ-মনস্তত্ত্ব, রাষ্ট্র-মনস্তত্ত্ব এবং চারপাশে তাকালে আমরা সর্বত্র দেখতে পাই। আমরা বরং গৃহিণী বোনদের প্রতি সমাজ এবং রাষ্ট্রের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করতে চাই, প্রতিবাদ জানাতে চাই এমন দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে।

ঘরে বা ঘরের বাইরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত নন এমন কোন নারীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কী করেন? দেখা যায়, উনারা কেমন একটা অস্বস্তিতে পড়ে যান এবং অবশেষে বলেন উনারা কিছুই করেন না! এমন মায়েদের সন্তানদের কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, তাদের মা কী করেন? তারাও বলে, তাদের মা কিছুই করেন না। পরিবার এবং সমাজের অন্য সদস্যরাও এমনটাই মনে করে থাকে সাধারণত।

আসলেই কি আমাদের গৃহিণী বোনেরা কিছুই করেন না?

আমরা মনে করি, একটা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তথা উৎপাদন কাঠামো, শিক্ষা ব্যবস্থা সেই রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি তথা অর্ধেক নাগরিক নারীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় মনস্তত্ত্ব, সমাজ-মনস্তত্ত্ব কেমন হবে, সেটা নির্ধারণ করে দেয়। তেমনি নারীরা গৃহিণীর জীবন বেছে নিবেন নাকি কর্মজীবীর জীবন বেছে নিবেন, সেটাও অনেকটা নির্ধারিত হয় দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপরই।

তাই একটা দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গৃহিণীর জীবন বেছে নেওয়ার অনুকূল করে রেখে আমাদের বোনরা গৃহিণীর জীবন বেছে নেওয়ায় তাদের কাজকে হেয় করা, গুরুত্বহীন, ছোট মনে করাকে আমরা ভিক্টিম ব্লেইমিং বলেই মনে করি। অথচ আমাদের সমাজ বাস্তবতায় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আজো গৃহিণী বোনরা তাদের রোজগার করা স্বামীর চেয়েও প্রতিদিন প্রায় দ্বিগুণ কাজ করে থাকেন। তারা সংসারের যাবতীয় কাজ করেন। ক্ষেত্রবিশেষে কাজ পরিচালনা করেন, সহযোগিতা করেন এবং সন্তানদের লালন-পালন, তাদের পড়াশোনার খোঁজ-খবর, আত্মীয়-স্বজন, পরিবারের সদস্যদের দেখাশোনা থেকে শুরু করে সবই করেন।

মূলত নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করার মধ্যে সম্মান-অসম্মানের, স্বাধীনতার প্রশ্ন যতোটা না জড়িত, তারচেয়ে অনেক বেশি জড়িয়ে রয়েছে প্রয়োজনের প্রশ্ন, দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রশ্ন। ইউরোপে ঊনিশ শতকে শিল্পের ব্যাপক বিকাশ, ১৮৩৭ ও ১৮৭০-এর অর্থনৈতিক মন্দা, আমেরিকার গৃহযুদ্ধে (১৮৬১-১৮৬৫) কর্মক্ষম পুরুষদের যুদ্ধক্ষেত্রে গমন ইত্যাদি কারণে নারী ও শিশুদের কারখানাগুলোতে কাজে যোগদান করা ছাড়া কোন বিকল্প ছিল না।

বাংলাদেশেও বর্তমানে যেসব বোনেরা গার্মেন্টস কারখানায়, নির্মাণ শিল্পে, ইটভাটা, মিডিয়া, অফিস-আদালত ইত্যাদিতে কাজ করছেন, সেটাও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তথা উৎপাদন ব্যবস্থা বিকাশের কিছুটা ধারা তৈরি হয়েছে বলেই সম্ভব হয়েছে। তাই যতদিন পর্যন্ত আমাদের অধিকাংশ বোনদের উৎপাদনের সাথে তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সরাসরি যুক্ত হওয়ার বাস্তবতা রাষ্ট্র তৈরি করতে না পারছে, ততদিন তাদের সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই।

নারী অঙ্গন মনে করে, গৃহিণী বোনরা ঘরের যাবতীয় কাজ এবং সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন বলেই তাদের স্বামীরা অর্থাৎ আমাদের ভাইয়েরা ঘরের বাইরে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন, অর্থ উপার্জন করতে পারেন। অথচ তারা স্বামীর জীবিতাবস্থায় সেই সম্পত্তির অংশীদার হতে পারেন না, অংশীদার বলে বিবেচিত হোন না।

বৈষম্যমূলক উত্তরাধিকার আইনের মাধ্যমে একদিকে কন্যা সন্তানদের পিতার সম্পত্তি থেকে ক্ষেত্রবিশেষে পুরোপুরি বঞ্চিত করে এবং অপরদিকে অর্ধেক অংশীদার করার মধ্য দিয়ে পুরোপুরি বঞ্চিত করার সুযোগ তৈরি করে দিয়ে রাষ্ট্র গৃহিণী বোনদের সবচেয়ে নাজুক অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলে আমরা মনে করি। সংসারে সারা দিন-রাত খেটেও, অবদান রেখেও তারা প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে সারা জীবন অতিবাহিত করেন। পান থেকে চুন খসলেই আতঙ্কের মধ্যে থাকেন, এই বুঝি স্বামী-গৃহ থেকে উচ্ছেদ হবেন। অনেক স্বামীও আমাদের গৃহিণী বোনদের এই অসহায় অবস্থার সুযোগ নেন।

খবরের কাগজে যদিও সারা দেশে ঘটে চলা ঘটনার খুব সামান্যই খবর আকারে আসে। তারপরও আমরা আমাদের বোনদের বিশেষ করে গৃহিণী বোনদের উপর স্বামীর, স্বামীর পরিবারের সদস্যদের পাশবিক নির্যাতনের, হত্যাকাণ্ডের যেসব খবর দেখি প্রতিদিন সেসব আমাদের আতঙ্কিত করে, মর্মাহত করে। এসব দেখে নারী বলে শুধু যে আমাদেরই কষ্ট হয় এমন না, বিবেকবান যেকোন মানুষেরই হওয়ার কথা। তাই—

১. গৃহিণী বোনদের এবং দেশের সমস্ত বোনদের নিরাপদ, নিশ্চিত এবং সম্মানজনক জীবন নিশ্চিত করার জন্য আমরা সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কন্যা সন্তানদের পিতার সম্পত্তিতে ভাইদের সমান হিস্যা দেওয়া এখন সময়ের প্রয়োজন বলে মনে করি। এবং রাষ্ট্রকেই এই উদ্যোগ নিতে হবে।

২. ঘরের কাজের আর্থিক স্বীকৃতি দিয়ে গৃহিণী বোনদের বিচ্ছেদের পর তারা যেন বিয়ের পর স্বামীর উপার্জিত সম্পত্তির অর্ধেক অংশীদার হতে পারেন, এই মর্মে আইন প্রণয়ন করতে হবে।

শিশু সন্তান কান্নার মধ্য দিয়ে নিজের ক্ষুধা কিংবা অসুস্থতা কিংবা পটি নষ্ট করে দেওয়ার কথা জানান না দিলে নিজের গর্ভধারিণী মা-ও দুধ পান করতে দেন না কিংবা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন না। গৃহিণী বোনদেরও নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে নিজেদের নিরাপদ, নিশ্চিত এবং সম্মানজনক জীবনের জন্য পিতার সম্পত্তিতে সমান অংশীদারিত্বের পাশাপাশি বিচ্ছেদের পর স্বামীর উপার্জিত সম্পত্তিতে যেন আইনগতভাবে সমান অধিকার লাভ করা যায়, সেজন্য সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন সকল ধরনের বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে কানেক্টিভিটি বাড়ানো এবং সংগঠিত হওয়া। নারী অঙ্গন আপনাদের সাথে আছে, পাশে আছে।

আরো পড়ুন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাম্প্রতিকা