শুক্রবার, ডিসেম্বর ২০, ২০২৪
Homeমুক্ত আওয়াজমাধ্যমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ আন্দোলন ও আশু করণীয়

মাধ্যমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ আন্দোলন ও আশু করণীয়

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাথে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধাদী থেকে সর্বক্ষেত্রে রয়েছে বিস্তর বৈষম্য। এইসব বৈষম্য দূরীকরণের জন্য এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সরকার কোন রকম কর্ণপাত না করায় শেষ পর্যন্ত তারা বাংলাদেশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)-র ব্যানারে এক দফা দাবি নিয়ে নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে ১১ জুলাই থেকে ঢাকা প্রেস ক্লাবের সামনে জোরদার আন্দোলনে নামেন। কী সেই তাদের এক দফা দাবি? এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা।

প্রায় মাসব্যাপী চলে তাদের সেই আন্দোলন। আন্দোলন চলাকালে শিক্ষকদের উপর চলে কয়েক দফা নির্মম পুলিশি আক্রমণ, লাঠিচার্জ। ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় আহত শিক্ষকদের সেই রক্তাক্ত ছবি দেখতে হয়েছে জাতিকে। শেষ পর্যন্ত আগস্টের প্রথম সপ্তাহে শিক্ষামন্ত্রীর কাছ থেকে জাতীয়করণের বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ২ টি কমিটি গঠনের আশ্বাস পেয়ে শিক্ষকরা আন্দোলন স্থগিত করে নিজেদের শ্রেণিকক্ষে ফিরে যান।

এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক চাকরি শুরু করেন ১১তম গ্রেডে, যার মূল বেতন ১২,৫০০৳। সাথে ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া, ৫ শত টাকা চিকিৎসা ভাতা পেয়ে থাকেন তারা। অর্থাৎ ১৪ হাজার টাকা। সেখান থেকে অবসর সুবিধা ও কল্যাণ তহবিলের জন্য ১০% অর্থাৎ ১,২৫০৳ কেটে রেখে দেয়। এরপর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিএড ডিগ্রি ছাড়া শিক্ষকরা পান সাকুল্যে ১২,৭৫০৳। এছাড়া তারা ২০% অর্থাৎ ২,৫০০৳ বাংলা নববর্ষ ভাতা এবং ঈদ বোনাস মূল বেতনের ২৫% অর্থাৎ  ৩,১২৫৳ পেয়ে থাকেন। চলতি অর্থ বছর থেকে এর সাথে যুক্ত হবে আরো ৫% আর্থিক প্রণোদনা।

এতক্ষণ হিসেব দিলাম যাদের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদানের সময় বিএড থাকে না, তাদের বেতনের। আর যাদের বিএড থাকে, তারা ১০ম গ্রেডে ১৬,০০০৳ মূল বেতন এবং একইরকম হারে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ও কর্তনের পর মাস শেষে পাবেন ১৫,৯০০+৮০০ টাকা। অর্থাৎ ১৬,৭০০৳।

*আর এমপিওভুক্ত কলেজে নিয়োগ পাওয়া প্রভাষকরা পান ৯ম গ্রেডে ২২ হাজার টাকা মূল বেতন এবং সহকারী স্কুল শিক্ষকদের মতো একই হারে বাড়ি ভাড়া ১ হাজার টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা ৫ শত টাকা। কর্তনও হয় একইভাবে ১০%। অর্থাৎ ২১,৩০০+১,১০০৳ বা ২২,৪০০৳।

স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যারা নিয়োগ পান, তাদের মধ্যে খুব কম জনেরই নিয়োগের সময় বিএড ডিগ্রি থাকে। পরবর্তীতে তারা বিএড করে নেন, যা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। চাইলেই কেউ যোগদানের পরপরই বিএড করার সুযোগ পান না। শিক্ষক সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠান প্রধান অনুমতি দিতে গড়িমসি করেন অনেক সময়।

১. ১৩ হাজার ৩৭৫ টাকা বেতন দিয়ে একজন শিক্ষকের পক্ষে আজকের দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির দিনে কোথাও বাসা ভাড়া করে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব কি?

২. পরিবারের কথা না হয় বাদই দিলাম। বাড়ির বাইরে একাকি একজন ব্যাচেলর শিক্ষকের পক্ষেও কি ন্যূনতম ভদ্রস্থ জীবন যাপন করা সম্ভব এই বেতন দিয়ে?

৩. এমনকি নিজের বাড়িতে থেকেও এই বেতন দিয়ে পরিবার নিয়ে আজকের দিনে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা কতোটা সম্ভব?

৪. মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ জীবনের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। পেটে ক্ষিধে নিয়ে, বাস করার মতো ন্যূনতম মানসম্পন্ন বাড়িতে না থেকে, পরিবার দূরে রেখে, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে না পারার অক্ষমতা নিয়ে, হীনমন্যতা নিয়ে একজন শিক্ষকের পক্ষে কী করে শ্রেণিকক্ষে গিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া সম্ভব? তাদের পক্ষে স্বপ্ন দেখানো সম্ভব? আমরা তাদের কাছ থেকে সেটা প্রত্যাশা করবো কোন যুক্তিতে?

অথচ সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকগণ ৪০%, ৫০% এবং ক্ষেত্রবিশেষে ৬০% হারে বাড়ি ভাড়া পেয়ে থাকেন। আবার নিজেদের সুবিধা মতো জায়গায় বদলি হয়েও আসতে পারেন তারা। এমপিওভুক্ত স্কুল এবং কলেজের শিক্ষকদের নিয়োগ থেকে শুরু করে সব রকম কার্যক্রমই অনলাইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে যতোদূর জানি। এরপরও তাদেরকে এখনো বদলির আওতায় নিয়ে না আসা তাদের প্রতি বড় রকমের বৈষম্যমূলক আচরণ এবং অবিচার বলেই আমার কাছে মনে হয়।

নিজের এলাকা থেকে, জেলা থেকে দূর-দূরান্তে নিয়োগ পাওয়া ইনডেক্সধারী শিক্ষকগণ NTRC-র পরবর্তী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এতোদিন আবেদন করতে পারতেন। এতে কেউ কেউ হয়তো নিজ নিজ এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলে আসতে পারতেন। কিন্তু এতে মূল সমস্যা শুধু থেকেই যেত না, একটা সমস্যার চক্রের মধ্যে পড়ে যেতেন পূর্ববর্তী নিয়োগ পাওয়া ইনডেক্সধারী অধিকাংশ শিক্ষক এবং  যারা নতুন নিয়োগ প্রত্যাশী, তারাও। এতে যারা আগে চাকরি পেয়েছেন, তারাই শূন্য পদগুলো দখল করে নিতেন। বেকার চাকরি প্রত্যাশীদের চাকরির সম্ভাবনা অনেক কমে যেত। সেই সাথে আবার তাদেরও নিজের এলাকায় আসার যুদ্ধ শুরু হতো। ৪র্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে অবশ্য ইনডেক্সধারীদের পুনরায় আবেদনের সুযোগ রহিত করা হয়েছে। এটাও কিন্তু সমাধান নয়। এতে দূর-দূরান্তে চাকরি হওয়া ইনডেক্সধারীদের উপর বাড়ির কাছে আসার অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে।

ধরে নিলাম, শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসিত জাতীয়করণ যাচাই-বাছাই কমিটি (যদিও সেই কমিটি আদৌ কখনো গঠিত হবে কি না, সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না) এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারি বা জাতীয়করণের পক্ষে মত দিবেন। তবু সে লক্ষ্যে কাজ করার জন্য, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য বহু বছর সময় লেগে যাবে। আমরা দেখেছি ২০১৮ সালে প্রত্যেক উপজেলার একটি করে স্কুল এবং কলেজ জাতীয়করণ করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ এখনো সরকারি হতে পারেননি। সেখানে সারা দেশের প্রায় ২০ হাজারের অধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং লাখ লাখ শিক্ষক, কর্মচারীর তথ্য যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা এক বিরাট মহাযজ্ঞ। সেক্ষেত্রে নিচের পদক্ষেপগুলো শিক্ষকদের ক্ষোভ, বঞ্চনাকে অনেকটা প্রশমিত করতে পারে এবং তাদের আর্থিক সমস্যারও অনেকটা আশু সমাধান দিতে পারে।

১. এমপিওভুক্ত স্কুল এবং কলেজের শিক্ষকদের কাছ থেকে মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং সেবা পেতে হলে অনতিবিলম্বে তাদেরকে বদলির আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। একটু আন্তরিক হলেই এটা সম্ভব। দরকার কেবল নীতি নির্ধারকদের আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছা।

২. বদলি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত মূল বেতন কম থাকায় নিজ উপজেলার বাইরে কর্মরত সহকারী শিক্ষকদের শুরুতে ১০০ শতাংশ হারে এবং কলেজের শিক্ষকদের ৬০, ৫০, ৪০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হলে তারা কিছুটা হলেও আর্থিক সংকট থেকে দূরে থাকতে পারবেন বলে মনে করি। নিজের উপজেলায় হলে এবং বদলির সুযোগ সৃষ্টির পর সরকারি স্কুল কলেজের মতো একই হারে বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যেতে পারে।

সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য হাতের কাছে পাওয়া সহজলভ্য পথকেই বেছে নিয়েছে। আমাদের শিক্ষকগণও দূর-দূরান্ত থেকে নিজের এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলে আসতে এবং নিজেদের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করতে হাতের কাছে পাওয়া সহজলভ্য পথকেই সমাধান হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা তৈরি হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে এবং শিক্ষকদের জীবনেও।

শিক্ষকগণ ক্লাসে আন্তরিকতার সাথে না পড়িয়ে, পর্যাপ্ত সময় না দিয়ে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের বাইরে কোচিং সেন্টারে, প্রাইভেটে আলাদা করে পড়তে বাধ্য করছেন। শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করছেন। এর ফলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং জাতি অপূরণীয় ও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির মুখে পড়ছে।

শৈশবে বাবার আমলে দেখেছি ৩/৪ মাস পরপর স্কুল থেকে বেতন পেতে। ছোট হলেও বুঝতে পারতাম, বেতনের টাকা কয়েক দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যেত। এখন পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বটে। মাসের বেতন মাসেই পেয়ে যান আমাদের শিক্ষকরা। কিন্তু কেউ যদি কোচিং বাণিজ্যে না নামেন, তাদের জীবন যাপন আগের মতোই দারিদ্র্যে, অভাবে-অনটনে দুর্বিষহভাবে কাটার কথা। তাই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হওয়া প্রয়োজন। আমাদের স্বপ্নের এবং মেরুদণ্ডের কারিগররা জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নিজেদের জীবনকেও যেন স্বাচ্ছন্দ্যে এবং নিশ্চিন্তে কাটাতে পারেন। আর এমনটা নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।


অদিতি জামান
কলেজ শিক্ষক

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাম্প্রতিকা