আজ ৮ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ।
সকাল থেকেই সারাদিন থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। কখনো মুষলধারায়, কখনো হালকা বৃষ্টি। শরতের বাদলা যেমন হয় আরকি। বিকেলের দিকে আবারো সূর্য্যিমামার দেখা মিলেছে। পাঁচটার দিকে পৌর পার্কে গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড! মুখোমুখি দুই সারিতে স্টলের পর স্টল দিয়ে, বাহারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে নিয়ে বিক্রি করছেন, পণ্য প্রদর্শন করছেন নারী উদ্যোক্তারা। মেলায় আসা ক্রেতা এবং দর্শনার্থীরা মেলা ঘুরে ঘুরে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী পণ্য পছন্দ করে ক্রয় করছেন। নতুন আগ্রহী উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ এসে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন, হাট কেমন চলছে এবং কীভাবে হাটে স্টলের বরাদ্দ পেতে পারেন।
‘নরসিংদী জেলা নারী উদ্যোক্তাদের মেলা’ নামে একটি অনলাইন প্লাটফর্মের উদ্যোগে আয়োজিত ‘সাপ্তাহিক পণ্য প্রদর্শনী হাট’টি নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন পৌর পার্কে প্রতি শনিবার বসে দুপুর ৩ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত চলে। মাসখানেক ধরে মেলাটি পৌর পার্কেই বসছে। এর আগে হাটটির সূচনা হয়েছিল এই বছরের ২৭ মে সাবরিনা সরকার নামে একজন নারী উদ্যোক্তার উদ্যোগে, তারই বাসার ছাদে। সেখান থেকে হাটটি স্থানান্তরিত হয় স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের আঙিনায়। পরবর্তীতে হাটের জনপ্রিয়তা এবং প্রসার ঘটায় স্টেশন সংলগ্ন পৌর পার্কে চলছে মাসখানেক যাবৎ।
নরসিংদী জেলার নারী উদ্যোক্তাদের এই হাটে কাঁথা, মেহেদী, অর্গানিক সাবান, স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট, ক্যানভাস কাপড়ের তৈরি ব্যাগ, জুয়েলারি পণ্য, নকশি পিঠা ছাড়াও হরেক রকমের পিঠা, কেক, ব্লক, বাটিক ও বুটিকসের থ্রি-পিস, বাচ্চাদের বাহারি জামা, বিছানার চাদর, টবে হরেক রকমের ফুল ও গাছের চারা ইত্যাদি পণ্য বিক্রি ও প্রদর্শনী হয়। বেশিরভাগ পণ্যই উদ্যোক্তাদের নিজেদের তৈরি। সৌখিন বাড়ির স্বত্বাধিকারী কামরুন নাহার কেয়ার সাথে আলাপ হচ্ছিল তার তৈরি জুয়েলারি পণ্য নিয়ে।
“উপকরণ কিনে নিয়ে এসে এগুলা আমি নিজেই বানাই। অর্থাৎ আমি নিজেকে সম্পূর্ণ একজন উদ্যোক্তা হিসেবে দাবি করতে পারি।”
সানজিদা’স বুটিকস হাউজের মালিক সানজিদা ইসলাম সুতা ও তুলির ছোঁয়ায় ক্যানভাস কাপড়ের তৈরি ব্যাগকে অনন্য রূপ দেন। হাটে সানজিদা ইসলামকে তার স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাইলে বলেন, “মেলাতে আমি এসেছি প্রচারের জন্য। কম মূল্যে দিচ্ছি, এটা কাস্টমারদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য। পরবর্তীতে বড় পরিসরে কাজ করার ইচ্ছে আছে।”
প্রায় ১০০ জন নারী উদ্যোক্তা এই হাটে পণ্য নিয়ে হাজির হোন। সবাই যে প্রতি সপ্তাহে আসতে পারেন কিংবা শুরু থেকেই আসতেন এমন না। কেউ আছেন এই সপ্তাহে শুরু করেছেন, কেউ ২ সপ্তাহ আগে, আগামী সপ্তাহে হয়তো নতুন নতুন আরো নাম যুক্ত হবে। শুরুর দিকে কয়েকজন পুরুষ উদ্যোক্তা হাটে পণ্য নিয়ে আসলেও এখন শুধু নারীরাই আসছেন এবং ভবিষ্যতে কেবল নারীদেরই সুযোগ দেওয়া হবে বলে জানান হাটের আয়োজকদের একজন সাবরিনা সরকার।
এই হাটে আসা উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ তাদের স্বামী, ভাই, বোন, বাবা কিংবা সন্তানকে নিয়ে আসেন কাজে সহযোগিতা করার জন্য। একজন বললেন, তার স্বামী তাকে সব রকম সহযোগিতা করেন। বাজার থেকে উপকরণ কিনে এনে দেন সব সময়। আজকেও মেলায় এসেছে কাজে সহযোগিতা করার জন্য।
সানজিদা সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এতোদূর আসতে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে কি না তাদের?
“প্রোডাক্ট ভালো না, পরিবেশ ভালো না ইত্যাদি অপপ্রচার চালায় কেউ কেউ। …ভালো কাজে বাধা আসেই। এগুলো মোকাবেলা করেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে।”
জেলার কেন্দ্রস্থলে শুধু নারী উদ্যোক্তাদের নিজেদের তৈরি পণ্য নিয়ে মেলা বা হাট যা-ই বলি না কেন, এটি একটি অনন্য উদ্যোগ। এই উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ এখনো ছাত্র। হাত খরচ চালানোর জন্য উদ্যোক্তা হয়েছেন। কেউ কেউ ভবিষ্যতেও তাদের কাজকে স্থায়ী পেশা হিসেবে নিতে চান। কেউ কেউ এতো দিন গৃহিণী ছিলেন, যারা স্বল্প পরিসরে পরিবারের জন্য খাবার তৈরি করতেন কিংবা সৌখিন কাপড় বুনতেন বা তৈরি করতেন। এখন তারা এই কাজ করে স্বাবলম্বী হতে চান।
নারী উদ্যোক্তাদের এই হাটে আসা ক্রেতা এবং দর্শনার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই নারী, ছেলেদের সংখ্যা খুবই কম। হাটে ক্রেতা এবং দর্শনার্থী হিসেবে আসা তামান্না হকের সাথে হাট নিয়ে, হাটে আসা পণ্য নিয়ে জানতে চাইলে বলেন, “ভিড় দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে, হাট অনেক জনপ্রিয়। মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে পারছে, হোমমেইড খাবার পাচ্ছে, যেটা ফ্রেশ আর হাইজেনিক। আর কাপড়-চোপড়ও দেখলাম অনেক ভালো। …আমি তো অনেকবার আইছি, খাবার নিছিও। খাবারগুলো অনেক ভালো। ফ্রেশ। টেস্টও ভালো।”
এই হাটের আয়োজকরা তাদের যাত্রাপথ এই পার্কেই থামিয়ে দিতে চান না। সবাইকে সাথে নিয়ে যেতে চান বহুদূর, যেখানে থাকবে সব নারী উদ্যোক্তাদের জন্য নিজস্ব স্থান, সম্মিলিত অফিস, অনলাইনে লাইভ প্রচারণার বিশেষ আয়োজন।
যারা স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি সঠিক পরিকল্পনা করতে জানে, কঠোর শ্রম দিতে জানে, জানে সততার সাথে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে, স্বপ্ন তো তাদের কাছেই ধরা দেয়। নরসিংদী জেলার নারী উদ্যোক্তাদের স্বপ্নও একদিন আলোর মুখ দেখবে। তাদের চোখ, মুখ আর আত্মা থেকে বেরিয়ে আসা প্রতিটি শব্দ সে ইঙ্গিতই যেন দিচ্ছিল।
ছবি : নারী অঙ্গন
অসংখ্য ধন্যবাদ নারী অঙ্গন পত্রিকাকে আমাদের নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করার জন্যে। আমাদেরকে সবার সামনে তুলে ধরার জন্যে , আশা করি নারী অঙ্গন এইভাবেই আমাদের নারী উদ্যোক্তাদের পাশে থাকবে।
ভালো লেখা