শনিবার, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪
Homeবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিরোকেয়ার বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-পরিবেশ ভাবনা ও নতুন আলোয় 'সুলতানার স্বপ্ন'

রোকেয়ার বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-পরিবেশ ভাবনা ও নতুন আলোয় ‘সুলতানার স্বপ্ন’

একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতায় বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ নির্মাণনারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আমাদের আরো সৃজনশীল ভাবনা দরকার। নারীর শিক্ষাসহ বেশ কিছু সামাজিক অধিকার এক সময় যা ছিল আন্দোলন করে অর্জনের বিষয়, সেগুলো এখন ভিন্ন আঙ্গিকে রাষ্ট্রেরই এজেন্ডা! ফতোয়া নিষিদ্ধ হয়েছে। পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কিছু নারী এখন চাকুরি, ব্যবসা, আদালত, কারখানা, খেলার মাঠ …স-ব সব জায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। উদ্যোক্তা হিসেবে কিছু নারীর সফলতা অনেক ক্ষেত্রেই ঈর্ষনীয়। রাষ্ট্র  ক্ষমতার সর্বোচ্চ পদগুলোতে নারীরা আসীন। তা সত্ত্বেও বেশিরভাগ মানুষের চিন্তা কাঠামোতে নারীর অবস্থান ঊনবিংশ শতাব্দীর তুলনায় খুব একটা আগায়নি। উৎপাদন কাঠামোর পাশাপাশি চিন্তা কাঠামোর এই পশ্চাৎপদ অবস্থান একটা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেও নারীর যে নূন্যতম সুযোগ- সুবিধা, অধিকার ও ক্ষমতায়ন হওয়ার কথা, সে পথে এক বিরাট বাধা। বাস্তবে  বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণ ও নারীর ক্ষমতায়নের মতো পরস্পর সম্পর্কিত দুটি বিষয়কে এক সুতায় গেঁথে সমাধান হাজির করা, সেজন্য সহজ কাজ নয়। সেই কঠিন কাজটিই বহু বছর আগে ‘সুলতানার স্বপ্নে’ রোকেয়া করে গিয়েছেন। সে কারনে নারীবাদী বিশ্লেষণের পাশাপাশি রোকেয়ার অমর রচনা ‘সুলতানার স্বপ্ন’কে নতুন আলোয় দেখা, এই সময়ের জন্য ভীষণ জরুরি।

‘সুলতানার স্বপ্ন’(১৯০৫) লেখা হয়েছিল আজ থেকে ১১৮ বছর আগে। যে গল্পে নারীবাদ, পরিবেশ, রাষ্ট্রচিন্তা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য শক্তির  মিশেলে এক অদ্ভুত রাষ্ট্র কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে শিক্ষা ও গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। লেখনীর সময় বিচারে ‘সুলতানার স্বপ্ন’কে একটি আধুনিক বিজ্ঞান কল্পকাহিনী বলা চলে।  কিন্তু ১৯o৫ সালের প্রেক্ষাপটে যা ছিল কল্পকাহিনী, আজ তার অনেক কিছুই বাস্তবে দেখা যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও সেসব বাস্তবতা সাংস্কৃতিকও ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে বর্তমান যুগেও অনেক বেশি সীমাবদ্ধ। দারিদ্রতার কঠিন দেয়াল ডিঙ্গিয়ে আজো বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার খুব কম মানুষের কাছেই পৌঁছাতে পারে। আমাদের দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণায় আজো নারীদের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। বলতে গেলে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খোঁজে বের করার মতো অবস্থা।

অথচ ১১৮ বছর আগে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কল্পকাহিনীত উন্নত এক সমাজ ব্যবস্থার ছবি এঁকেছেন রোকেয়া। যেখানে নারীই প্রধান চালিকাশক্তি। নারীবাদী চিন্তার আলোকে এই গল্পে তখনকার সমাজের সমস্যা চিহ্নিত করার সাথে সাথে এমন সব বৈজ্ঞানিক সমাধান হাজির করা হয়েছে, যা অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত, সহজলভ্য ও দারুণ পরিবেশ-বান্ধব।  ১৯০৫ সালে লেখা হলেও ধারনাগুলো বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্যও সমান প্রাসঙ্গিক। যেমনঃ আমরা জানি আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সংকটের নাম পরিবেশ। কারন গত ১০০ বছর ধরে শিল্প, পরিবহণ, আবাসন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কৃষিতে যে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা হয়েছে, তার প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে ডেকে এনেছে ভয়াবহ পরিবেশগত ও সামাজিক বিপর্যয়। ইন্টান্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-র গবেষণা মতে, খুব শীঘ্রই বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহণ ও কৃষিক্ষেত্রে জ্বালানি ব্যবহারে যুগান্তকারী কোন পরিবর্তন ঘটানো না গেলে মানব-জাতিকে এক মহা- দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হবে। যার ছোট ছোট লক্ষন আমরা দেখতে পাচ্ছি পৃথিবী জুড়ে মৌসুমি ঝড়, সাইক্লোন, উত্তর গোলার্ধের তীব্র শৈত্য-প্রবাহ, দক্ষিণ গোলার্ধের ততোধিক তীব্র তাপদাহ, দেশের ভেতরে হাওড় বিপর্যয় এবং পাহাড় ধ্বসে শত শত মানুষের করুণ মৃত্যুতে। পরিবেশ সংকটের অন্যতম বড় সমাধান আসবে পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে কৃষি, বিদ্যুৎ ও পরিবহণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর মধ্য দিয়ে। শত বছর আগে ‘সুলতানার স্বপ্ন’তে রোকেয়া এসবের সমাধান আমাদের দিয়ে গিয়েছেন। এখানে উৎপাদন, যাতায়াত ও দৈনন্দিন প্রয়োজনে সৌর ও বায়ু শক্তির ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।

আপনারা রাঁধেন কিরূপে ? কোথাও ত অগ্নি জ্বালিবার স্থান দেখিতেসি না ?”

তিনি বলিলেন, সূর্য্যোত্তাপে রান্না হয়। অতঃপর কি প্রকারে সৌরকর একটা নলের ভিতর দিয়া আসে, সেই নলটা তিনি আমাকে দেখাইলেন।  কেবল ইহাই নহে ; তিনি তৎক্ষণাৎ এক পাত্র ব্যঞ্জন  (যাহা পূর্ব্ব হইতে তথায় রন্ধনের নিমিত্ত প্রস্তুত ছিল ) রাঁধিয়া আমাকে সেই অদ্ভুত রন্ধন প্রণালী দেখাইলেন।

বলা হয়েছে, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং এবং আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে কৃষি সেচের কথা। ‘অভিনব বেলুন’ আবিষ্কার করে কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে গরমকালে ঠাণ্ডা আমেজ নিয়ে আসা ও প্রাকৃতিক ঝড়বৃষ্টি, বজ্রপাত নিবারণ করেছিল নারীস্থানের বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষক ও ছাত্রীরা। ঠাণ্ডা ও গরম পানির নেটওয়ার্ক নির্মাণ করে নগরের অধিবাসীদের সেবা দেওয়ার কথাও রোকেয়া তাঁর রচনায় উল্লেখ করে গিয়েছেন। এখনো গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে প্রতিবছর যেখানে কয়েক শত নিরীহ মানুষ ব্জ্রপাতে প্রাণ হারায়, সেখানে রোকেয়া শতাধিক বছর পূর্বে প্রাকৃতিক উপায়ে ব্জ্রপাত নিরোধের কথা বলছেন।

—-আপনি ঐ যে বৃহৎ বেলুন এবং তাহাতে সংলগ্ন নল দেখিতে পাইতেছেন,-উহা দ্বারা আমরা যত ইচ্ছা বারিবর্ষণ করিতে পারি। আবশ্যক মত সমস্ত শস্যক্ষেত্রে জলসেচ করা হয়। আবার জলপ্লাবনেও আমরা ঈশ্বরকৃপায় কষ্টভোগ করি না। ঝঞ্ঝাবাত এবং বজ্রপাতেরও উপদ্রব নাই।

এইসব ব্যবস্থা বর্তমানে উন্নত দেশগুলোতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুৎ, পানি, পরিবহণ ও নগরায়ন সংকট সমাধানের উপায় হিসেবে অনেক আগেই রোকেয়া তাঁর রচনায় এসবের উল্লেখ করে গিয়েছেন। বর্তমানে সৌর শক্তির কয়েকটি ভিন্ন প্রযুক্তিগত ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন, কল কারখানার জন্য বাষ্প তৈরি এবং বাসা বাড়ির জন্য বিদ্যুৎ ছাড়াই পানি গরম করা হচ্ছে। এসবের মাধ্যমে আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি ও পারমাণবিক বিদ্যুতের ঝুঁকি থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে পারি। আবার বৃষ্টির পানি সঞ্চয় ও ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা পারি ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে।  নগর ও কৃষির প্রয়োজনে ভূগর্ভস্থ পানির অতি ব্যবহারে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত পরিমানে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় তা একদিন শেষ হয়ে গেলে পৃথিবী এক মহা দুর্যোগের মুখোমুখি হবে। আবার বাসাবাড়ি, খাদ্য ও অন্যান্য জিনিস ঠাণ্ডা করার কাজে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় তা থেকে সিএফসি গ্যাস নির্গত হয়ে ওজোনস্তর ক্ষয় হয়ে যায়। পাশাপাশি এসব গ্যাস তাপ ধরে রেখে ভয়ঙ্কর রকমের বৈশ্বিক উষ্ণতা সৃষ্টি করে। ওজোনস্তর ক্ষয় হলে সূর্য থেকে আসা ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি পৃথিবীতে সমস্ত প্রাণ, পরিবেশ, প্রকৃতি ধ্বংস করে ফেলতে পারে। সে কারনে ওজোনস্তরের ক্ষয়রোধ ও বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রতিরোধ করার উপায় হিসেবে বিকল্প গ্যাস ব্যবহার, ফ্রিজিং এর পরিবর্তে তাজা সবজি, মাছ, মাংস, ফল খাওয়া এবং ঘর ঠাণ্ডা করার কাজে এয়ার কন্ডিশনারের পরিবর্তে গবেষকরা গরমে সুক্ষ্ম ঝর্ণার মাধ্যমে ঠাণ্ডা পানি ছিটিয়ে ও শীতে গরম পানি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ঘর গরম করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন, যা উন্নত বিশ্বে বহুল ব্যবহৃত।

 ইদানিং নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সঞ্চয় করে তা দিয়ে  বৈদ্যুতিক গাড়ি চালানোর মাধ্যমে পরিবহণ ব্যবস্থা সারা দুনিয়ায় নতুন রূপ ধারন করেছে। যার মাধ্যমে পরিবহণ খাতের পরিবেশ দূষণ, কার্বন নির্গমন কমিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানো ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার চেষ্টা চলছে। এ ছাড়াও হাইপার লুপ, জেট প্রপালশান প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রাইভেট ড্রোনে দ্রুত দূরবর্তী গন্তব্যে যাবার প্রযুক্তিও প্রায় মানুষের হাতের মুঠোয়। উপরে উল্লিখিত প্রত্যেকটি প্রযুক্তির ধারনা ও কার্যকর ব্যবহারের বর্ণনা দেওয়া আছে ‘সুলতানার স্বপ্নে’তে বর্ণিত নারীস্থানে।

  “—অতঃপর এই অপরূপ বায়ুযানে দুইটী পাখার মত ফলা সংযুক্ত হইল, শুনিলাম ইহা বিদ্যুৎ দ্বারা পরিচালিত হয়। আমরা উভয়ে আসনে উপবেশ করিলে পর তিনি পাখার কল টিপিলেন।  প্রথমে আমাদের  তখতে রওয়াঁ’ খানি ধীরে ধীরে / হাত ঊর্ধ্বে উত্থিত হইল, তার পর বায়ুভরে উড়িয়া চলিল!      

শিক্ষাক্ষেত্রে নারীস্থানের নারীদের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা চিন্তা করা হয়েছে, যেখানে নারীরা অগ্রসর বৈজ্ঞানিক গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত থাকতেন। আর আবিষ্কার করতেন যুগোপুযোগী নানান প্রযুক্তি। নারীদের ব্যাপক হারে শিক্ষার্জন, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অংশগ্রহণ, নিত্য নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে নিজেদের জ্ঞান, সাহস, বুদ্ধি ও উদ্ভাবনী শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসা, তাদের গৃহাভ্যন্তরের বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়েছিল। যুগান্তকারী সেসব গবেষণা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বাণিজ্যেও ব্যাপক অবদান রেখেছিল। এইভাবে নারীস্থানের নারীরা শত্রুর আক্রমন থেকে রক্ষা করে দেশকে পরাধীনতার রাহুগ্রাস থেকে বাঁচিয়েছিল। শুধু তা-ই না, কোন প্রকার প্রাণহানী কিংবা ধ্বংসযজ্ঞ না ঘটিয়েই তারা শত্রুপক্ষকে জয় করেছিল। এইভাবে নারী নেতৃত্বে শিক্ষা ও বিজ্ঞান গবেষণা রাষ্ট্রকে প্রযুক্তিতে স্বনির্ভর হওয়া এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে।

তাহাদের নয়ন ঝলসিয়াছিল সত্য, কিন্তু সৌদামিনী প্রভায় নয়,- স্বয়ং তপনের প্রখর কিরণ!!—–

যোদ্ধাদের সঙ্গে সেই সূর্য্যোত্তা-সংগ্রহের যন্ত্র ছিল মাত্র।—নারীর হস্তে একটি লোকেরও মৃত্যু হয় নাইএক বিন্দু নরশোণিতেও বসুন্ধরা কলঙ্কিত হয় নাইঅথচ শত্রু পরাজিত হইল!    

   এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বিজ্ঞান গবেষণার মাধ্যমে প্রকৃতিকে যথেচ্ছভাবে নিয়ন্ত্রণ করা কিংবা ভোগের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতে বলা হয়নি। বরং মানুষ নিজেকে প্রকৃতির অংশ হিসেবে একে রক্ষা করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যাতে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী নির্মাণ করতে পারে সেইদিকে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় রোকেয়ার বিজ্ঞান দর্শন ছিল, মানব কল্যাণ ও আত্মরক্ষার প্রয়োজনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যাবহার করা।

আমরা অতল জ্ঞানসাগরে ডুবিয়া রত্ন আহরণ করি। প্রকৃতি মানবের জন্য তাহার অক্ষয় ভাণ্ডারে যে অমূল্য রত্নরাজি সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছে,আমরা তাহাই ভোগ করি। তাহাতেই আমরা সন্তুষ্টচিত্তে জগদীশ্বরকে ধন্যবাদ দিই।

এযাবতকাল ধরে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নিয়ে বেশিরভাগ আলোচনা ছিল, গতানুগতিক এবং নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে। নারী অন্তঃপুরে থেকে শিক্ষা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ একটি স্বপ্ন রাজ্য, যেখানে নারী তার বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞান- বিজ্ঞান দিয়ে নারী-প্রধান একটি সমাজ নির্মাণ করে। ঘটনাক্রমে সেখানে যুদ্ধক্ষেত্রে অদক্ষতার পরিচয় দিয়ে পুরুষ অন্তঃপুরের বাসিন্দা হয়। আর নারীরা পরাস্তপ্রায় একটি জাতির জন্য যুদ্ধ করে বিজয় এনে দেয়। এ গল্পে নারীরা তাদের জ্ঞান, দক্ষতা, উদ্যম ও কর্মতৎপরতার শক্তিতে যুদ্ধ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। এখানে লেখক নারীকে পুরুষের সমান নয় বরং তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর করে উপস্থাপন করেছেন। এ সমাজে কোন অপরাধ নেই। এখানে ধর্ম হল ‘প্রেম ও সত্য’। যেহেতু এই সমাজে কোন অন্যায় এবং অপরাধ নেই, সেহেতু এখানে নেই পুলিশি ব্যবস্থার মাধ্যমে কোন ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। নেই কোন ঝগড়া কলহ।

“আমাদের কোঁদল করিবার অবসর কই? আমরা সকলেই সর্ব্বদা কাজে ব্যস্ত থাকি- প্রকৃতির ভাণ্ডার অন্বেষণ করিয়া নানা প্রকার সুখ স্বচ্ছন্দতা আহরণের চেষ্টায় থাকি। অলসেরা কলহ করিতে সময় পায়- আমাদের সময় নাই।“

নারীস্থানে ‘সমস্ত নগরখানি একটি কুঞ্জ ভবনের মতো দেখায়! যেন প্রকৃতি-রাণীর লীলাকানন!’ সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে খাদ্যাভাব দূর করা হয়েছে। ফলে সেখানে ম্যালেরিয়া নেই, প্লেগ বা কলেরার মতো মহামারী হানা দিতে পারে না, ‘কাহারও অকাল-মৃত্যু হয় না’।

    “ আমাদের এখানে প্লেগ বা ম্যালেরিয়া আসুক ত দেখি!”

নারীস্থান নারীদের জন্য শাসনকার্য, শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার অবারিত রাখলেও পুরুষের জন্য সেসব কপাটবদ্ধ করে রাখেনি। তারা কেবল অন্ত:পুরে বন্দি হয়ে না থেকে নিজেদের পুরুষের সাথে কাজ ও ক্ষমতার ভাগাভাগি করে নিয়েছে, ‘শ্রমবণ্টন’ করে নিয়েছে নিজেদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে, সহাবস্থানের ভিত্তিতে। এখানে নারী পুরুষ মিলেই সুন্দর সমাজ, দেশ নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন রোকেয়া। মাঝে মাঝে পুরুষকে নিয়ে কিছু ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছেন এবং ‘জেনানা’র বিপরীতে ‘মর্দ্দানা’র অস্তিত্ব রেখেছেন বটে। তবে সেটা নারীদের গৃহাভ্যন্তরে বন্দী করে রাখার জন্য সমাজে প্রচলিত নারীদের সম্পর্কে অসম্মানজনক ধারণাকে খণ্ডন করার জন্য এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে সেগুলোর অসারতা, অযৌক্তিকতাকে এবং নির্মমতাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বলেই মনে হয়। কাহিনীর শেষ দিকে রোকেয়া যখন নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যে শ্রমবণ্টন করে নেওয়া এবং ‘নরনারী উভয়ে একই সমাজ-দেহের বিভিন্ন অঙ্গ,_পুরুষ শরীর, রমণী মন‘ বলে ঘোষণা দেন, তখন সে ধারনা আরো স্পষ্ট হয়। দু:খের বিষয়, সেইসব নেতিবাচক ধারণা এবং আচরণ থেকে সমাজ এবং নারীরা আজো মুক্তি পায়নি।

“কিন্তু কেরাণী ও শ্রমজীবী বলিতে ঠিক যাহা বুঝায়, এদেশের ভদ্রলোকেরা তাহা নহেন। তাঁহারা বিদ্যা, বুদ্ধি, সুশিক্ষায় আমাদের অপেক্ষা কোন অংশে হীন নহেন। আমরা শ্রম বণ্টন করিয়া লইয়াছি- তাঁহারা শারীরিক পরিশ্রম করেন, আমরা মস্তিষ্কচালনা করি। আমরা যে সকল যন্ত্রের উদ্ভাবনা বা সৃষ্টি কল্পনা করি, তাঁহারা তাহা নির্মাণ করেন। নরনারী উভয়ে একই সমাজ- দেহের বিভিন্ন অঙ্গ,-পুরুষ শরীর, রমণী মন!”

সব মিলে সুলাতানার স্বপ্নে নারীর শিক্ষা, মুক্তি, ক্ষমতায়ন ও বিজ্ঞান ভাবনা সেকাল-একাল এবং এ দেশে তো বটেই, বরং সারা বিশ্বের জন্যই মাইলফলক ছিল। সুলতানার স্বপ্নের নারীবাদী বিশ্লেষণ একে অর্ধেক বর্ণনা করে। কিন্তু নারীবাদী রুপকল্পের পাশাপাশি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, পরিবেশ ও নবায়নযোগ্য শক্তির আলোচনা রোকেয়া করেছেন সময়ের অনেক আগে, যা এই সময়ে আমাদের জন্য নতুন করে চিন্তার রসদ যোগাতে সাহায্য করছে। সেই সাথে রোকেয়া আমাদের এই পথও বাতলে দিচ্ছেন, যে শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণায় ব্যাপক হারে নারীর অংশগ্রহণ, তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথকে যেমন সুগম করতে পারে; তেমনি মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বন্দিদশা থেকে তাদের মুক্ত করে হাজার হাজার বছর পূর্বে ছিনিয়ে নেওয়া ক্ষমতা, সহাবস্থান এবং মুক্ত জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে।

তথ্যসূত্রঃবাংলা একাডেমী,ঢাকা প্রকাশিত এবং আবদুল কাদির সম্পাদিত রোকেয়া রচনাবলী(২০০৬) ।

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাম্প্রতিকা