কভিড-১৯ এর জন্য আমরা জানি, দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ঘটনাটা স্কুল কলেজ খুলে দেওয়ার কিছুদিন পরের। আমাদেরই একজন সিনিয়র সহকর্মী বারবার ফোনে চেষ্টা করেও উনার গাইডে থাকা ছাত্রীদের কলেজে আনতে পারছিলেন না, দেখা করতে পারছিলেন না। বিভাগেই একই কক্ষের খানিকটা দূরের টেবিলে বসে উনার পেরেশানি অবস্থা লক্ষ্য করছিলাম কয়েক দিন যাবৎ। হঠাৎ একদিন জানতে চাইলাম, ঘটনা কী? উনি জানালেন, তার গাইডে থাকা অধিকাংশ ছাত্রীই বিবাহিত। তারা কলেজ খোলার পর এতোদিন হয়ে গেলেও কলেজে আসছে না। ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না ঠিক মতো তাদের।
আমার গাইডে ছাত্ররা পড়েছে। তাদের সমস্যাগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। তাই বিষয়টা এতোদিন খেয়াল করিনি। এরপর আরো কয়েকজন গাইড টিচারের সাথে আলাপ করলাম, যাদের অধীনে ছাত্রীরা পড়েছে। আগের সহকর্মীর মতো তারাও একই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। তখন সারাদেশের অবস্থা জরিপ করে জানার ব্যাপক কৌতূহল কাজ করেছিল কিছুদিন। আগ্রহী ছিলাম মহামারির আগে আমাদের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীদের বৈবাহিক অবস্থা কেমন ছিল, জানার জন্যও। কিন্তু কভিড-১৯ শুরু হওয়ার কয়েক বছর আগে থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের দেখাশোনার জন্য শিক্ষকদের গাইড টিচার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হলেও আগে এতো সিরিয়াসলি তাদের সাথে যোগাযোগ করা হতো না, যা ইদানীং করা হচ্ছে। তাই আগের পরিস্থিতি জানা সম্ভব ছিল না। তবে একটা জিনিস খুব খেয়াল করছি কয়েক বছর যাবৎ, যে আশেপাশে পরিচিত জনদের মধ্যে বাল্যবিবাহের পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছে। তেমনি ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, পরিচিত জনদের মধ্যেও বাল্যবিবাহের পক্ষে সম্মতির ঘটনা চোখে পড়ছে অনেক।
“২৭ জেলায় ব্র্যাকের জরিপ
‘উপযুক্ত পাত্র’ পাওয়ায় ৪৪ শতাংশ বাল্যবিবাহ” শিরোনামে গত ৫ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন পড়ে আবারো আৎকে উঠলাম। ‘বর্ন টু বি এ ব্রাইড’ ( কনে হওয়ার জন্যই যেন জন্ম) শিরোনামে ব্র্যাকের সোশ্যাল এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড লিগ্যাল প্রোটেকশন (সেলপ) কর্মসূচির প্রকাশিত একটি জরিপ প্রতিবেদনের উপর প্রথম আলো তাদের প্রতিবেদনটি করেছে। বাল্যবিবাহের প্রবণতা ও কারণ খুঁজে বের করতে এ বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে দেশের ২৭টি জেলার ২ হাজার ৮০ গ্রামের ৫০ হাজার পরিবারের উপর ব্র্যাক জরিপটি পরিচালনা করেছে।
১৮ বছরের আগে না পরে –কখন মেয়েদের বিয়ে দেওয়া প্রয়োজন? এই প্রশ্নের জবাবে ৫০ শতাংশ অভিভাবক মনে করে্ন আগে এবং ৫০ শতাংশ মনে করেন ১৮ বছর বয়সের পরে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া উচিত। যারা মনে করেন ১৮ বছরের আগেই বিয়ে দেওয়া উচিত তারা বেশির ভাগই ১৮ বছরের আগেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। আর যারা মনে করেন ১৮ বছরের পর বিয়ে দেওয়া উচিত, তাদের মধ্যেও ১৮ শতাংশ ১৮ বছরের আগেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন।
জরিপ হওয়া ২৭টি জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ বাল্যবিবাহের হার পিরোজপুর জেলায় -৭৩ শতাংশ। এরপর চাপাইনবাবগঞ্জে -৬৫ শতাংশ। সবচেয়ে কম নেত্রকোনা জেলায়-২৪ শতাংশ। এই জরিপ বলছে, দেশের ৭০ শতাংশ কিশোরী বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে।
বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি-২০২৩, ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ১৫ বছর বা তার কম বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিয়ের হার ২৭ শতাংশ। ২০৪টি দেশের মধ্যে বাল্যবিবাহের হারের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৫ম এবং এশিয়ায় ১ম।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস)-২০২২ এর প্রতিবেদনও বলছে, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে বা বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ।
এতোদিন বাল্যবিবাহের জন্য দরিদ্রতা, সামাজিক নিরাপত্তাবোধের অভাব, অশিক্ষা ইত্যাদি যেসব কারণকে চিহ্নিত করা হতো, জরিপে এগুলো প্রধান কারণ হিসেবে উঠে আসেনি। ৪৪ শতাংশ বাল্যবিবাহ হয়েছে ‘উপযুক্ত পাত্র’ পাওয়ায়। স্বচ্ছল পরিবারেও বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ। ব্র্যাকের সেলপ কর্মসূচির প্রধান ও ইনচার্জ শাশ্বতী বিপ্লব বলেন, জরিপে বাল্যবিবাহের কারণ নিয়ে যেসব ধারণা প্রচলিত আছে, এর বাইরে অন্য কারনগুলো বেশি পাওয়া গেছে। অভিভাবকদের বাল্যবিবাহ দেওয়ার মানসিকতার পাশাপাশি সামাজিক চাপ থেকেও বাল্যবিবাহ হচ্ছে।
জুলেখারা ( ছদ্মনাম) ৩ ভাই-বোন। জেলা শহরে বাবা রিক্সা চালান, মা গৃহকর্মী। সমাজের মানদণ্ডে দেখতে শুনতে ভালো হওয়ায় বছর দেড়েক আগে ১৬ বছর বয়সে পরিবারের বড় এবং একমাত্র মেয়ে জুলেখার বিয়ে হয়ে যায় কয়েক মাইল দূরে গ্রামের এক গৃহস্থ পরিবারে। বাসায় তেমন কোন কাজকর্ম না করা জুলেখার বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি থেকে দুই দিন পরপরই মেয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতে থাকে। বুড়ি মেয়ে, মেয়ে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে, ঘরের কাজকর্ম করে না, মুখেমুখে কথা বলে ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলশ্রুতিতে জুলেখা শ্বশুর বাড়িতে থাকতে চায় না। খেটে খাওয়া বাবা-মার কাছেই বেশির ভাগ সময় থাকে। বউ বাপের বাড়িতে থাকে বলে মেয়ে জামাইও কাজকর্ম ফেলে রেখে সপ্তাহের বেশির ভাগ দিন বউয়ের কাছেই এসে থাকে। এখন ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে থাকা দিন এনে দিন খাওয়া জুলেখার বাবা-মা’কে মেয়ে এবং মেয়ে জামাই দুজনকেই পালতে হচ্ছে।
যে দেশে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে, জগতের আও-বাও জানা বুঝার আগে, ভবিষ্যতে জীবনে আসা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো দক্ষতা-যোগ্যতা অর্জন করার আগেই বাবা-মা-ভাই-বোন বিয়ে দিয়ে দায় থেকে মুক্তি পেতে চায়, নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে চায় এবং ‘অভাগার গরু মরে, ভাগ্যবানের মরে বউ’-র মতো প্রবাদ প্রবচনের জন্ম নিয়েছে, সেখানে বাল্যবিবাহের শিকার একজন কিশোরী শ্বশুরালয়ে দুধে-ভাতে দিনাতিপাত করবে, এমনটা সাধারণত হয় না, হওয়ার কথাও না। বাল্যবিবাহের ফলাফল:
১. শারীরিক ও মানসিক সমস্যা,
২. স্বাস্থ্যহানি,
৩. অপরিনত বয়সে সন্তান ধারণ,
৪. মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি,
৫. প্রসবকালীন শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি,
৬. প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা,
৭. অপুষ্ট ও প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম,
৮. পারিবারিক নির্যাতন,
৯. নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা,
১০. বিবাহ বিচ্ছেদ,
১১. স্কুল ও কলেজ থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি,
১২. নারী শিক্ষার হার হ্রাস,
১৩. নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ কমে যাওয়া,
১৪. মেয়েদের আরও ক্ষমতাহীন ও প্রান্তিক হয়ে যাওয়া।
ইউএনএফপিএ জানায়, ২০২০ ও ২০২১ করোনা মহামারির দুই বছরে বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের ৭৬ শতাংশ আর বিদ্যালয়ে ফিরেনি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি)-র এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে ১১ হাজার ৬৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়। ওই ছাত্রীরা বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। অর্থাৎ তারা বিদ্যালয় থেকে পুরোপুরি ঝরে পড়েছে চিরদিনের জন্য, (তথ্যসূত্র: মানবজমিন, ৪ অক্টোবর, ২০২২)। বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরীরা খুব কমই পরবর্তীতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে, চালিয়ে যায়। একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ চালিয়ে গেলেও বাচ্চা, সংসার সামলিয়ে বলার জন্য, সান্ত্বনার জন্য নামকাওয়াস্তে কেবল সার্টিফিকেটসর্বস্ব ডিগ্রি অর্জন করেন। এক্ষেত্রে দুই চারটা ব্যতিক্রম থাকতে পারে।
চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (২০২২) প্রকাশ করে। এতে বছরভিত্তিক মাতৃমৃত্যুর চিত্র দেখানো হয়। মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বাল্যবিবাহ ও কিশোরী গর্ভধারণকে মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করছেন।
ইউনিসেফ-এর লেভেলস অ্যান্ড ট্রেন্ডস ইন চাইল্ড মর্টালিটি রিপোর্ট-২০১৭ বলছে, নবজাতক মৃত্যুর ৮৮ শতাংশই ঘটছে সংক্রমণ, শ্বাসজনিত সমস্যা ও স্বল্প ওজন নিয়ে অপরিনত জন্মসংক্রান্ত কারণে। আর এসবের বড় একটি কারণ, কিশোরী মাতৃত্ব।
বাল্যবিবাহ অভিশাপ কি-না, কিংবা একটা মেয়ের জন্য ক্ষতিকর কি-না —এটা নিয়ে এই একুশ শতকেও যদি বিতর্ক করতে হয়, তাহলে বুঝতে হবে আমরা বিদ্যা, বুদ্ধি, মনন, মানবিকতায় সামনের দিকে যাচ্ছি না। যাচ্ছি মূলত পিছনের দিকে। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের বাত, আথ্রাইটিস, স্পোর্টস ইনজুরি ও পক্ষাঘাত রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা: মনিরুল ইসলামের সাথে বাল্যবিবাহ নিয়ে আলাপকালে কথা প্রসঙ্গে বলেন, ‘ফাইব্রোমায়ালজিয়া’ নামে মাংসপেশীর প্রচণ্ড ব্যথা জনিত একপ্রকার রোগ আছে, যা সাধারণত নারীদেরই হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের শিকার নারীরা মানসিক নিগ্রহের শিকার হয়ে এই রোগে বেশি আক্রান্ত হোন বলে তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, যেসব নারী মানসিক রোগে আক্রান্ত হোন, তাদের মধ্যে মাত্র ১০% এর মতো ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য আসেন। আর যারা আসেন, দেখা গেছে বেশির ভাগই বাল্যবিবাহের পর শ্বশুর বাড়ির নিগ্রহের শিকার হয়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
স্বচ্ছল পরিবারেও বাল্যবিবাহের হার (৫০%) বেড়ে যাওয়া কিংবা ‘উপযুক্ত পাত্র’ পেয়ে যাওয়া কিংবা সামাজিক চাপ কিংবা সামাজিক নিরাপত্তাবোধের অভাব কিংবা যৌতুক না চাওয়া বা কম চাওয়া ইত্যাদি কারণে বাল্যবিবাহ হওয়া বা বাল্যবিবাহের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকে শুধু সচেতনতার অভাব বলে, দায়িত্ব শেষ করে দেওয়ার পক্ষপাতী নই। আরও গভীরে গিয়ে তলিয়ে দেখতে চাই, কেন কিশোরী মেয়েদের বিয়ের জন্যই, সামাজিক চাপ কিংবা সামাজিক নিরাপত্তারবোধের অভাব কিংবা কেন অল্প বয়সেই অভিভাবকরা ‘উপযুক্ত পাত্র’ পেয়ে যান। অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের বা কিশোরদের বিয়ে দেওয়ার জন্য এইসব ফ্যাক্টর কাজ করে না কেন?
ভাবতে খারাপ লাগলেও কিংবা বলতে মন্দ শোনালেও, একটা বিষয় আমাদের অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। আমাদের দেশে শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে বেশির ভাগ মানুষের কাছেই মেয়েরা আজো একটা পণ্যই। সেই পণ্য বা যন্ত্র, যাকে কেবল যৌনতা এবং সন্তান জন্মদানের জন্যই উপযুক্ত বলে মনে করা হয়। নারীকে আবার শুধু পণ্য না, মাছ কিংবা সবজির মতো পচনশীল এমনই এক পণ্য ভাবা হয়, যা সকাল সকাল বিকোতে হয়। না হলে যতো বেলা গড়াতে থাকবে, ততো তার মূল্য কমতে থাকবে বিক্রেতার কাছে। সচেতন কিংবা অবচেতন, যেভাবেই হোক, অভিভাবক এবং পাত্রপক্ষের মধ্যে, এই ভাবনাই কাজ করে মূলত। তাই একপক্ষ তাজা মাছ ক্রয় করতে চান। আর অপর পক্ষের ভাবনা থাকে, মাছ তাজা থাকতে থাকতে হাত বদলের। তাছাড়া পণ্যকে আমরা নিজেদের মতো করে, নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে চাই। তাই লেখাপড়া শিখে ডানা গজানোর আগে, উড়তে শেখার আগেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে ডানা কেটে দেওয়া হয়, যাতে নিজেদের ইচ্ছেমতো তাদের চালানো যায়। যাতে মেয়েদের নিজস্বতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, ঔচিত্যবোধ গড়ে উঠতে না পারে।
লোককে বলতে দেখা যায়, বাসিফুলে নাকি দেবতার পুজোও হয় না! আমাদের এই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুরুষ হলো গিয়ে দেবতা। আর নারী ফুল বা বাসিফুল! দেবতারা যতো কিছুই করুক, তাদের কোন কলঙ্ক নেই। সব কলঙ্ক হয় গিয়ে ভিক্টিম মেয়েদের। দেখুন না, অহল্যার কোন দোষ ছিল? ছিল না। দেবতা ইন্দ্র স্বামীর রূপ ধারণ করে ফাঁকি দিয়ে তার সাথে শারীরিক সম্পর্কে গেলেন। অথচ প্রস্তরমূর্তি হয়ে যুগের পর যুগ শাস্তি কিনা অহল্যাকেই পেতে হলো! আমাদের সমাজেও মেয়ে নামক ফুলরা কারো সাথে সম্পর্কে গিয়ে বা প্রেমে পড়ে বাসি হওয়ার আগেই, তাদের যাতে স্বামী নামক দেবতার উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য হিসেবে অর্পণ করা যায়, সেই চিন্তা/ দুশ্চিন্তা থাকে মেয়ে এবং ছেলে উভয় পক্ষেরই। তাই বড় বড় পাশ দেওয়া লোকদেরও অনেককে বিয়ে করার সময় স্কুলে পড়া পাত্রী খুঁজতে দেখা যায়।
বর্তমানে আমাদের শিক্ষা হয়ে গিয়েছে ব্যয়বহুল এবং একই সাথে সার্টিফিকেট ও চাকুরিসর্বস্ব। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে এখানে কিছু টাকা থাকলে এবং পড়াশোনা থেকে ঝরে না গেলে, ভালো ফলাফল নিয়ে সার্টিফিকেট অর্জন করা হয়ে গিয়েছে পান্তাভাতের মতো সহজ। সেই তুলনায় বিরাট অঙ্কের স্পিড মানি ছাড়া ছোটখাটো চাকরি জোগাড় করা হয়ে গিয়েছে সোনার হরিণ জোগাড় করার মতোই কঠিন কাজ। বছরের পর বছর ভালো ফলাফল নিয়ে অনার্স-মাস্টার্স পাশ করেও বসে থাকতে হচ্ছে ছেলেমেয়েদের। অথচ ১৫/২০ বছর আগেও এইচএসসি পাশ করেই স্পিড মানি ছাড়াই নিজেদের যোগ্যতায় কোন না কোন ছোটখাটো চাকরি জোগাড় করে নিতে পারতো তারা। এতে শুধু শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা না, সমগ্র জনগোষ্ঠীই লেখাপড়ার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ভাবছে, মেয়েদের এতো পড়াশোনা করিয়েই বা কী হবে! চাকুরি পাবে তার তো কোন নিশ্চয়তা নেই। ছেলেদের না হয় বিদেশ পাঠিয়ে দিতে পারবে কিংবা দেশে থাকলে ব্যবসা বাণিজ্য করবে। কিন্তু মেয়েরা? তখন তো শিক্ষিত মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র মেলানোও কঠিন হয়ে যাবে! এবং বাস্তবে ঘটছেও তা-ই।
ইদানীং একটা গোষ্ঠী চাকরিজীবী নারীর মাতৃত্বকালীন ছুটিকে স্ক্যাম বলে প্রচার করে, মেয়েদের ফাইভ পাশ- ইন্টার পাশের বেশি পড়ানো উচিত না বলে ফতোয়া দিয়ে, বেগম রোকেয়াকে নিয়ে, শিক্ষিত নারীর ডিভোর্স নিয়ে, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা অভিভাবকদের উস্কে দিচ্ছে মেয়েদের বেশিদূর পড়াশোনা না করিয়ে বাল্যবিবাহ দিয়ে দিতে। প্রায় ২০ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে বিভাগের ৩৫ ঊর্ধ্ব একজন শিক্ষক সবে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া মেয়েকে বিয়ে করায়, বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা খুবই হাসাহাসি করতো এ নিয়ে। চারপাশের অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ঘটনাটা আজকের দিনে হলে, পুরষ্কারস্বরূপ উনাকে হয়তো সংবর্ধনা দেওয়া হতো কারো কারো পক্ষ থেকে।
নব্বুইয়ের দশকের শেষ দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেঞ্চুরি মানিকের ঘটনা আমাকে সেখানে ভর্তি পরীক্ষা দিতেই ভয় পাইয়ে দিয়েছিল, নিরুৎসাহিত করেছিলো। ফলশ্রুতিতে ঢাকার কাছে এতো সুন্দর একটা বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি ফরমই তোলা হয়নি। সেঞ্চুরি মানিকের কোন বিচার কিন্তু করা হয়নি। রাতের আঁধারে তাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করা হয়েছে উল্টো। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এই রকম বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটার সুযোগ করে দিয়ে এবং অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় না এনে, রাষ্ট্র নারীদের পড়াশোনা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে নারী শিক্ষা এবং চাকুরির বিরুদ্ধে অপপ্রচার করার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুইভাবেই।
২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৯৬% জমির মালিকানা পুরুষের হাতে আর মাত্র ৪%-এর মালিকানা নারীর। এই ৪%-ও আবার সমাজের ধনী এবং সুবিধাপ্রাপ্ত নারীদের হাতে। আইনগতভাবে ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে নারীদের এই রাষ্ট্র যেভাবে সম্পত্তিহীন, ক্ষমতাহীন করে রাখতে পারছে, তাদের মধ্যে প্রধান কারণ দেশের বিরাট সংখ্যক নারীর বাল্যবিবাহ এবং তাদের উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ না দেওয়া। নিজস্বতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, ঔচিত্যবোধ, সচেতনতা, অধিকারবোধ তৈরি না হতে দেওয়া। আবার অন্যভাবেও বলা যায়, সম্পত্তিহীন ও ক্ষমতাহীন করে রাখার জন্য এবং নিজস্বতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, ঔচিত্যবোধ, অধিকারবোধ গড়ে উঠতে না দেওয়ার জন্যই, বাল্যবিবাহের এমন আয়োজন সর্বত্র।
২০১৭ সালে সরকার “বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন -২০১৭” পাশ করে। এই আইনে বাল্যবিবাহের সাথে জড়িতদের কঠোর শাস্তি ও জরিমানার বিধান যেমন রাখা হয়েছে, তেমনি বিশেষ বিধান করে বাল্যবিবাহকে আবার বৈধতাও দেওয়া হয়েছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে যারা কাজ করেন, তারা এই বিশেষ বিধানের অপপ্রয়োগের কথা বলেন। বাল্যবিবাহ নেই এমন কিছু অগ্রসর দেশেও বাংলাদেশের মতো বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু সেই সব দেশে তো কোন বাল্যবিবাহ হচ্ছে না। তাই একটা দেশে আইনগতভাবে বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স কতো ধরা হলো, তার উপর সেই দেশের বাল্যবিবাহের হার বাড়া কিংবা কমা মূলত নির্ভর করে না। বাল্যবিবাহের জন্য যেসব কারণ কাজ করে, সেগুলো বিদ্যমান থাকলে দায়সারাভাবে কেবল আইন করে জরিমানা ও শাস্তির বিধান দিয়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা যাবে না। সেই কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে সবার আগে। আর এই খুঁজে বের করার কাজটা রাষ্ট্রকেই করতে হবে এবং খুঁজে পাওয়া কারণগুলো নির্মূলের দায়িত্বও রাষ্ট্রেরই। আর রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কাজ রাষ্ট্র যেন এই কাজগুলো ঠিকঠাক মতো করে, সেজন্য জনমত গড়ে তোলে প্রতিনিয়ত চাপ প্রয়োগ করে যাওয়া রাষ্ট্রকে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ৫২ বছরেও দেশের নিরক্ষরতা ও দারিদ্র্য দূর করতে পারে না, অল্প কিছু ক্ষেত্র ব্যতীত মোটা অঙ্কের স্পিড মানি ছাড়া ছোটখাটো চাকুরির ব্যবস্থা রাখেনি তার নাগরিকদের জন্য, ধর্ষকদের বিচারের মুখোমুখি না করে উল্টো বিদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার সম্পূর্ণ অবৈতনিক না করে দিয়ে উল্টো ব্যয়বহুল করে রেখেছে, মেয়েদের পণ্য হিসেবে দেখার বাস্তবতা সমাজে জারি রেখেছে, মেয়ে শিশু জন্মের পর থেকেই অভিভাবকদের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগায়, যৌতুকের জন্য দু:শ্চিন্তাগ্রস্ত করে, রানিং নারী প্রধানমন্ত্রীকে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিরোধী দলের নারী নেতার ব্যক্তি চরিত্র হনন করে জনসম্মুখে দুই দিন পরপর রসিয়ে রসিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে না, তেমন একটা পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় এই কাজ কতোটা সম্ভব? কিংবা আদৌ সম্ভব কি-না?
চমৎকার বিশ্লেষণ
ধন্যবাদ তোমাকে, ঝুমুর
চমৎকার ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আপা।
ধন্যবাদ, আপা