নতুন কারিকুলাম ও শিক্ষণ- শিখন পদ্ধতি নিয়ে সারা দেশ উত্তাল। এই প্রশ্নে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সর্বোপরি দেশবাসী আজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটা অংশ বলতে চাইছেন, এইগুলা কোন শিক্ষাই না। এর ফলে দেশ, জাতি ও ছেলেমেয়েরা উচ্ছন্নে যাবে। আরেকটা অংশ বলার চেষ্টা করছেন, এতোদিনের মুখস্থ-নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার আমাদের। শিক্ষা হওয়া দরকার জীবন- ঘনিষ্ঠ ও আনন্দময়।
নতুন কারিকুলামের সমালোচনা করতে গিয়ে একজন উচ্চশিক্ষিত অভিভাবক বললেন -“আমি নিজেও কোনদিন আলু ভর্তা বানাই নাই, আর স্কুলে আমার ছেলেকে আলু ভর্তা বানানো শিখাচ্ছে! ঘর ঝাড়ু দিতে, মা’কে রান্নার কাজে সাহায্য করতে বলছে! এটা ওটা বানিয়ে নিতে দিচ্ছে! এটা শিক্ষা!?”
তো এইরকম গার্জিয়ানরা, বিশেষ করে পুরুষ, যারা গ্লাসে পানিও ঢেলে খান না কোনোদিন, উনারা অনার্স-মাস্টার্স পাশ বউ (বিনা বেতনের পার্মানেন্ট কাজের লোক) দিয়েই এসব কাজ করিয়ে নিতে অভ্যস্ত। বাচ্চাদের সারাদিন ঘরে আটকে রেখে বই গেলানো গার্জিয়ানরা ভাবেন ৯/১০ টা সাবজেক্ট মুখস্থ করে গোল্ডেন পেলেই হয়, বাকি কাজ তো কাজের লোক এসে করে দিবে। উনাদের গর্বের শেষ নাই, বাচ্চা গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাইছে বলে। অথচ জুতার ফিতাটাও বাঁধতে শিখানো হয় না এইসব ছেলে-মেয়েদের। কলেজে পড়া মেয়েকে কোনো কোনো অভিভাবক আছেন, যারা এখনো একা বাড়ি থেকে বের হতে দেন না! নিজেরা মেয়েকে কলেজে নিয়ে আসেন এবং বসে থেকে ছুটি হলে আবার বাসায় নিয়ে যান!
তো, এই শিক্ষা ব্যবস্থায় তো পেলেন একটা পর-নির্ভর জাতি। যারা বেশির ভাগই নিজেদের কাজটা ঠিক মতো করে না, চাকরি করতে চায় নবাবের মতো। তারা কাজ করাকে, সেবা দেওয়াকে দাসত্ব মনে করে। ঘুষ, দুর্নীতি, দালালি, চাটামি সবই তো পাইছেন। এবার একটা কারিকুলাম দেখেন, যেটাতে কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে, প্রাত্যহিক জীবনকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের কাজ নিজে করতে শিখাবে। এতে ছেলে-মেয়েরা নিজেদের সমস্যাগুলো নিজেরা সমাধান করতে শিখবে, বিপদ আপদে সিদ্ধান্ত নিতে শিখবে, শিল্প-সংস্কৃতিকে ধারণ করে মাল্টি-ট্যালেন্টেড হয়ে উঠবে।
আমি এক পরিবারে দেখেছি, একজন মায়ের দুটো সন্তান। মেয়েটা ইন্টারে পড়ে, ছেলেটা অনার্সে। মা অসুস্থ হয়ে, প্রেসার বেড়ে দাঁতে দাঁত লেগে অজ্ঞান হয়ে গেছে। অথচ ডাক্তার ডেকে আনার মতো সাহস ছেলেটার হয়নি। তারা প্রেসার মাপতেও জানে না। মা কোন ঔষধটা খাচ্ছে, জানেনা। এক পোঁয়া চাল ফুটিয়ে ভাত রান্না করতে পারে না, ডিম ভাঁজতেও পারে না। অসুস্থ মা ঘন্টা দুই /তিন পরে স্বাভাবিক হয়ে তারপর রান্না করে সন্তানদেরকে খাইয়েছে। আমার নিজ চোখে দেখা। তো, বাবা-মা বা পরিবারের কেউ এমন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দিয়ে সব কাজ না করিয়ে ছেলে মেয়েরা নিজের রান্না, কাপড় ধোঁয়া নিজে করবে। আর স্বাভাবিক সময়েও তো যার যার প্রাত্যহিক কাজগুলো নিজেরা করলে একজন দুই জনের ওপর নির্ভর করতে হয় না, চাপ পড়ে না।এছাড়া প্রত্যেকেরই তো নিজ নিজ কাজ এবং আলাদা জীবন আছে।
আর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা হাসি-তামাশা করছেন, তারা নিজেদের ঘরে থাকা অভিজ্ঞ বা অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারি শিক্ষকদের বর্ণিল অভিজ্ঞতাগুলো শুনবেন। একটানা ১০/১২ দিন ট্রেইনিং। ভোরবেলা ওঠে জগিং করা, কুকুরের বাচ্চা কীভাবে ডাকে? বিড়াল কয়টি ছানা দেয়? বাবা- মা একসাথে খেতে বসলে সন্তান পায়খানা করে দিলে হাতের প্লেট রেখে কে সন্তানকে পরিষ্কার করে দিয়ে আবার খেতে বসে? প্রাইমারি শিক্ষকদের মধ্যে নারীর অগ্রাধিকার কেনো? এমন হাজারো অভিজ্ঞতার ঝুলি তাদের আছে। এগুলো শুনবেন। বাচ্চাদের জন্য হাঁসের ডাক, সাইকেলের ক্রিং ক্রিং, ঘোড়ার খুঁড়ের আওয়াজ, ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাক, হাতের তালুতে বৃষ্টির শব্দ তোলা কতোটা আনন্দদায়ক। শিক্ষকদের চঞ্চলতা, আনন্দদায়ক মুভমেন্টগুলো বাচ্চাদের এবং টিনেজারদের কল্পনার পরিধি বাড়ায়। বস্তা-ভরা বই মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়ে ফেলার পর কিছুদিন পরে তেমন কিছুই মনে থাকে না, ভুলে যায়। মনোজগতে তা প্রশ্নের উদ্রেক করে না। বাচ্চার ভেতরে জানার কৌতূহল জাগায় না। হাতে কলমে শেখা কাজ সারাজীবন কাজে লাগে। চিন্তা, চেতনায়, মননে ধারণ করা শিক্ষা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জ্ঞানী এবং অনুসন্ধিৎসু করে তোলে।
একটা স্কুল যখন বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখবে, মনে রাখবেন, তখন বাবা- মা নিজেদের ক্যারিয়ার এবং নিজেদের সময়গুলো নিয়ে আলাদা কাজ করার সুযোগ পাবেন। তারা নিজেদের যত্ন নিতে সময় পাবেন। আমাদের আলালের ঘরের দুলাল /দুলালি পালা বন্ধ করতে হবে। শিক্ষাব্যাবস্থায় একটা পরিবর্তন নিয়ে আসা জরুরি। একঘেয়ে গৎবাঁধা মুখস্থবিদ্যায় পরিবর্তন জরুরি। নয়তো আর পঞ্চাশ বছর পরে দেখা যাবে, এই জাতি আরও অথর্ব, পরনির্ভর হয়ে গেছে। ভারতের মানুষও হয়তো তখন চিনে বলে স্বীকার করবে না, অন্য দেশ তো দূরের কথা। একটা জাতিকে চেনার জন্য যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো দরকার, সেসব বৈশিষ্ট্য বাচ্চাদের ভেতর থেকে বের করে আনার দায়িত্ব সকলের। বাবা- মা, শিক্ষক, রাষ্ট্র এবং শিক্ষা ব্যবস্থার। আমরা একটা মাল্টি-ট্যালেণ্টেড ভবিষ্যৎ প্রজন্ম চাই, তার জন্য যা কিছু করতে হয়, সেটা সকলে মিলে করবো। সব ধরনের মতানৈক্য আলোচনা করে শেষ হোক, একটা সুস্থ সুন্দর সমাজ আমাদের সকলেরই কাম্য।
অবশ্য কেবল কারিকুলাম কিংবা শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতির উপর কোনো দেশেরই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গড়ে ওঠা নির্ভর করে না। সেটা যতোই উন্নত দেশগুলোকে অনুসরণ করে করা হউক না কেন। একটা দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা-দর্শন কেমন হবে, সেক্ষেত্রে নির্দেশক শক্তি হিসেবে কাজ করে। তেমনিভাবে রাষ্ট্র তার সম্পদের কতটুকু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার পিছনে খরচ করবে, কারিকুলাম কেমন হবে, শিক্ষকদের মান, বেতন ও মর্যাদা কেমন হবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ও পরিবেশ কেমন হবে, সেসব নির্ধারণ করে দেয়।
তাই কেবল কারিকুলাম ও শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি নিয়ে প্রশংসা কিংবা সমালোচনা সীমাবদ্ধ না রেখে, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি তথা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের শিক্ষা-দর্শন প্রভৃতির দিকেও দৃষ্টি ফেরানো জরুরি। তবে সব রকম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা চাই, শিক্ষা হউক জীবন-ঘনিষ্ঠ ও আনন্দময়।