বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪
Homeনারী স্বাস্থ্যআসুন, পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা) সম্পর্কে অবগত হই

আসুন, পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা) সম্পর্কে অবগত হই

বেশ কিছুদিন আগে অনলাইনে একটা ভাইরাল ছবি দেখতে পাই, যেখানে একজন মা হাসপাতালের নার্সের কাছ থেকে ছোট একটা কাগজ চেয়ে নেন। এবং সেখানে লিখে দেন “আমি বাবুর রক্ত খাবো!” কথাটা শুনতে অতীব ভয়াবহ। কোন সুস্থ মা কি এমনটা বলতে পারেন? কিংবা এমনটা কখনো ভাবতেও পারেন!? নিশ্চয়ই ও-ই মা সুস্থ ছিলেন না। আমি জানি না, ও-ই মা তার সঠিক মানসিক চিকিৎসাটি পেয়েছিলেন কি-না। না-কি জ্বীন ভূতের আছর লেগেছে ভেবে তার পরিবার পানি-পড়া, ঝাঁড়-ফুক, তাবিজ- কবজের আশ্রয় নিয়েছিল।

বলছিলাম, প্রসব-পরবর্তী মানসিক বিষণ্ণতা বা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের কথা। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৫ ভাগ নারী এবং ১–২৬% পুরুষ প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতায় ভুগেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণার তথ্য বলছে, এর মধ্যে ৫-৯ ভাগ মানুষ শিশুহত্যা/আত্মহত্যা ঘটিয়ে ফেলে। সন্তান প্রসবের আগেও এই বিষণ্নতা শুরু হতে পারে। অথচ আমরা খুব কম মানুষই এই সম্পর্কে অবগত আছি। এমনকি পুরুষও এই সমস্যায় ভুগতে পারে, যা অনেকেরই অজানা।

কোন দম্পতি যখন দু’চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে সন্তানের আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন, তখন থেকে নানা রকম শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যান তারা। সন্তান আগমনের খবরে কারো খুশি, কারো অখুশি, আর্থিক সমস্যা, পারিবারিক কলহ, মায়ের নতুন/পুরনো অসুস্থতাসহ নানান সমস্যার মধ্য দিয়ে এই ডিপ্রেশনের প্রথম ধাপ শুরু হতে থাকে। প্রায় ১০ মাসের দীর্ঘ জার্নির পরে একটা সন্তান জন্ম নেয়। কেউ নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে, কেউ বা হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকেন। এরপর বাবা মায়ের আসল যুদ্ধ শুরু হয়। ছোট এই একরত্তি বাচ্চার চোখের ভাষা, মুখে বলতে না পারা অঙ্গভঙ্গির সাথে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করতে হয়। বেশিরভাগ বাবা মা-ই প্যারেন্টিং সম্পর্কে অজ্ঞ থাকায় প্রথম প্রথম কিছুই করতে পারেন না, বুঝেন না। অন্যদিকে সাহায্য করার মতো সব সময় কেউ থাকেও না পাশে। ফলে নতুন বাবা মা হয়ে পড়েন অসহায়। আবার অনেক বাবা এ ব্যাপারে উদাসীন থাকায় সম্পূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়ে মায়ের উপর।

সন্তান জন্মের খুশিতে মায়ের কথা ভুলে যায় সকলে।সকলে বাচ্চাকে আদর যত্ন করা নিয়ে ব্যাস্ত থাকে। নতুন
মা তখন নিজের যত্ন এবং সন্তানের যত্ন নিতে গিয়ে ভুল করতে থাকেন। এই সময় সন্তান লালন-পালনে সহযোগিতা না করে আত্মীয়- স্বজনরা ভুল ধরতে থাকেন মায়ের। নির্ঘুম রাত, গর্ভকালীন ধকল সামলানো, হরমোনের উঠানামা, ঔষধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় বিপর্যস্ত মা তখন নিজের ভুল নিয়ে সংশয়ে পড়ে যান। অনেকে মৃত শিশু জন্ম দেন বা বাচ্চা জন্মের সাথে সাথে বড় ধরনের অসুখ ধরা পড়ায় মা ও সন্তানের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। সুস্থ না হতেই সংসারের কাজ করতে চাপ দেওয়া, বড় বাচ্চা থাকলে তার যত্ন, স্বামী ও অন্যদের যত্নের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া, মারধর বা খারাপ ব্যাবহার, মনোমালিন্যের শিকার হওয়াসহ নানান ঝামেলার মুখে পড়েন। তখন শুরু হতে থাকে ডিপ্রেশনের চরম মাত্রা। নিজের অপারগতা, অসুস্থতা, সিদ্ধান্তহীনতা, হীনমন্যতায় ভুগে (অকারণেও হতে পারে) অসহায় অবস্থায় একজন মা বাচ্চাকে তখন বিরক্তিকর, পিছুটান, অকল্পনীয় ভবিষ্যৎ ভেবে এবং অপ্রয়োজনীয় ভেবে হত্যা এবং ফেলে দেওয়ার মতো চিন্তা করে বসেন। বিবেকের বাইরে গিয়ে এতো কষ্ট করে জন্ম দেওয়া সন্তানকে নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া মায়ের আসলে কোন জাগতিক সেন্সই থাকে না। অথচ তাকে দেখতে বাইরে থেকে সুস্থ মনে হতে থাকে।

এই ধরনের লক্ষ্মণগুলোকে যে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বলে, অধিকাংশ মানুষ তা বুঝতে পারেন না। এই বিষয়ে তারা তেমন কিছু জানেনও না। ঠিক কী কারণে এ ধরণের সমস্যা তৈরি হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা সঠিক তথ্য দিতে পারেন না। অতিরিক্ত মানসিক দুশ্চিন্তা বা ঔষধের প্রভাব বা কোন কারণ ছাড়াও পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন হতে পারে। পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য হলোঃ-

১। সর্বদা অস্থির থাকা, শরীর জ্বালাপোড়া করা, চোখে ঘুম থাকা স্বত্বেও ঘুমাতে না পারা।

২। হুট করে রেগে যাওয়া, এগ্রেসিভ আচরণ করা, সবার সাথেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও খারাপ আচরণ করে বসা।

৩। বাচ্চার প্রতি বন্ধুত্ব বা মায়া কাজ না করা, বাচ্চার কান্না, তাকে সেবা করা বিরক্তিকর এবং বোঝা মনে করা।

৪। খুব বেশি সেনসিটিভ হয়ে যাওয়া, কান্নাকাটি করা, এলোমেলো কথা বলা, সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, কেউ সান্ত্বনা দিলেও তা নিতে না পারা।

ব্যাক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন আচরণও প্রকাশ পেতে পারে। এই রকম পরিস্থিতিতে একজন মায়ের দরকারঃ-

১। পর্যাপ্ত ঘুম, পুষ্টিকর খাবার, নিয়মিত ঔষধ সেবন।

২। পরিবারের সকলের সম্মিলিত সাহায্য, যাতে মা ও শিশু উভয়েই পর্যাপ্ত সময় নিয়ে নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারে।

৩। পারিবারিক কলহ দূরে রেখে মানসিক সকল ঝামেলা কথা বলে মিটিয়ে ফেলা।

৪। স্বামীর সহায়তা, উপস্থিতি, আর্থিক টানাপোড়েন মিটানো এবং স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে পাশে থাকা।

৫। যেকোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া, সঠিকভাবে কাউন্সেলিং, ঔষধ এবং সময় নিয়ে ধৈর্য্য ধরে চিকিৎসা সেবা নিয়ে যাওয়া।

অনেক সময় নতুন মা প্রসবের পরে কিছু অস্বস্তিতে ভোগেন। এই ধরণের সমস্যা নিজে নিজে ঠিক হতে গর্ভধারণ থেকে শুরু করে প্রসব পরবর্তী ১৫ দিন থেকে ৩ মাস সময় লাগে। আর সময়ের সাথে সাথে ঠিক না হয়ে গেলে এই ডিপ্রেশন দুই থেকে তিনবছর এবং অন্যান্য ডিপ্রেশন মিলে তা অনেকের জীবনে স্থায়ীও হয়ে যেতে পারে, যা একটা পরিবার এবং সমাজের জন্য ভয়াবহ হতে পারে। সকলের সম্মিলিত চেষ্টায় একজন মা ও শিশু, সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে। সুখে শান্তিতে ভরে উঠতে পারে প্রতিটি পরিবার । আসুন, আমরা সকলে মিলে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করি, যেখানে একজন বাবা-মা দিনের পর দিন পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভুগে আত্মঘাতী হয়ে না ওঠেন। সকলের সহযোগিতা ও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং সুস্থ, সুন্দর, নিরাপদ একটি পরিবার, সমাজ ও পৃথিবী গড়ে তুলতে পারেন।

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাম্প্রতিকা