“দিল্লি ক্রাইম” নামে একটা বিখ্যাত ওয়েব সিরিজ আছে। এর প্রথম সিজন ২০১৯ সালে মুক্তি পেয়েছিলো। নির্ভয়া মামলা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিলো এই সিজনটা।
২০১২ সালে দিল্লিতে একজন মেডিকেল ছাত্রী একদল পুরুষ কর্তৃক সম্মিলিত ধর্ষণ, বীভৎস নির্যাতন ও হত্যার শিকার হোন। এই ঘটনায় ভারতজুড়ে তীব্র আলোড়ন তৈরি হয়েছিলো। নিপীড়নের শিকার মেয়েটি পরবর্তীতে ডটার অফ ইন্ডিয়া আখ্যা পেয়েছিলেন।
ওই একই বছর, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ১৫৭৪ জন দলিত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্যানুসারে, প্রতিদিন গড়ে ৪ জন দলিত নারী অ-দলিত পুরুষদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হোন। কেউ এঁদের ডটার অফ ইন্ডিয়া বলে নাই। সবার কপালে এমনকি মরণোত্তর সান্ত্বনাটুকুও জোটে না।
কারা এই দলিত?
হিন্দু সমাজ ঐতিহ্যগতভাবে প্রায় ৪,০০০ জাতিতে বিভক্ত। এদের মধ্যে দুই ভাগ: স্ববর্ণ আর অবর্ণ। স্ববর্ণ বা বর্ণ হিন্দুরা চারটি বর্ণে বিভক্ত। মর্যাদাক্রম অনুসারে এরা হচ্ছেন ব্রাহ্মণ (পুরোহিত), ক্ষত্রিয় (যোদ্ধা), বৈশ্য (ব্যবসায়ী) ও শুদ্র (ভৃত্য)। এই জাতিভেদ প্রথায় অবর্ণদের অবস্থান শুদ্রেরও নিচে। যাঁরা এককালে অস্পৃশ্য হিসেবে বর্ণিত হতেন, যাঁদের ছোঁয়াটুকু পর্যন্ত বর্ণ হিন্দুদের কলুষিত করে। আজকাল এঁরা দলিত বলে বর্ণিত হয়ে থাকেন, যাঁদের একাংশ হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কিংবা মুসলমান হয়েছেন।
ভারতীয় সংবিধানের রূপকার আম্বেদকার এমনই এক দলিত। কিন্তু আজকে আমরা তাঁর কথা বলব না। বলব এক দলিত নারী সুরেখা ভূতমাঙ্গের গল্প।
২.
এই গল্পটা দিল্লি ক্রাইমের ৬ বছর আগের।
৩.
২০০৬ সালে সুরেখার বয়স ছিল ৪০ বছর। থাকতেন মহারাষ্ট্রের খাইরলাঞ্জিতে। তিনি ছিলেন ভারতের অসংখ্য দলিত নারীদের মধ্যে একজন।
সুরেখা অপরাপর দলিত নারীর তুলনায় ভাগ্যবান ছিলেন। অন্তত অর্থনৈতিক বিচারে। কারণ তাঁকে ঠিক হতদরিদ্র বলা যায় না। তিনি তাঁর স্বামী ভাইয়ালালের তুলনায় শিক্ষিত ছিলেন। ফলে স্বীয় পরিবারের প্রধান বলে বিবেচিত হতেন। আরেক দলিত আম্বেদকারের মত সুরেখার পরিবারও হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করেছিলো এবং বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলো। তাঁর দুই ছেলে সুধীর ও রোশন কলেজ পর্যন্ত পড়েছিলেন। আর একমাত্র মেয়ে প্রিয়াংকা হাই স্কুলের পাঠ চুকিয়েছিলেন।
কিন্তু জাতিভেদ প্রথা যে ভারতের সবচে মৌলিক সমস্যা, শিক্ষা আর টাকাও যে দলিতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না, খুব দ্রুত তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
৪.
সুরেখা আর তাঁর স্বামী ভাইয়ালাল মহারাষ্ট্রের খাইরলাঞ্জি গ্রামে অল্প এক টুকরো জমি কিনেছিলেন। জমিটি ঘিরে ছিল সেই জাতিদের খামার, যারা জাতিভেদ প্রথায় সুরেখার জাতি মাহারদের চেয়ে নিজেদের উঁচু বিবেচনা করে। সুরেখার জন্য যাদের কোন সহমর্মিতা ছিলো না।
সুরেখা ভূতমাঙ্গে দলিত হওয়ায় গ্রাম পঞ্চায়েত তাঁর জন্য বহু অধিকারের পথ আটকে রেখেছিল। এর মধ্যে ছিল, বিদ্যুৎ সংযোগ না দেওয়া। মাটির ঘরকে পাকা বাড়ি বানাতে না দেওয়া। গ্রামবাসী সুরেখার পরিবারকে কূপ থেকে পানি আনতে দিতো না, সেচ কার্যে খালের পানি ব্যবহার করতে দিতো না। তারা সুরেখার জমির ওপর দিয়ে সড়ক বানানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে জমিটির ওপর গরুর গাড়ি চালিয়ে দেয়। সুরেখার ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলতে নিজেদের গৃহপালিত পশুর পাল তাঁর মাঠে ছেড়ে দেয়। এই সবকিছুর উদ্দেশ্য ছিল সুরেখার উন্নতি ঠেকানো।
ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অধিকার সচেতন সুরেখা হাল ছাড়ার পাত্রী ছিলেন না। পুলিশে অভিযোগ করলেন। পুলিশ প্রথমে তাঁর অভিযোগ আমলে নেয় নাই। পরবর্তী মাসগুলোতে গ্রামটিতে চরম উত্তেজনা বিরাজ করে। সুরেখার প্রতি প্রদানকৃত একটা হুঁশিয়ারি হিসেবে গ্রামবাসী তাঁর এক পুরুষ আত্মীয়কে খুন করে। তিনি আবার পুলিশের কাছে গেলেন, অভিযোগ করলেন।এবার পুলিশ অল্প কিছু অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করলো।কিন্তু শিগগিরই এই অভিযুক্তরা জামিন পেয়ে যান।
তারপর যা ঘটবে, তাকে বর্ণনা করতে মানব ভাষা যথেষ্ট নয়, ‘নারকীয় নির্যাতন’ শব্দদ্বয় অতি ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গিয়েছে।
৫.
সেপ্টেম্বর ২৯, ২০০৬।
স্থান: খাইরলাঞ্জি, মহারাষ্ট্র।
সময়: বিকেল ছয়টা।
৭০ জন ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী, নারী ও পুরুষ উভয়েই, ট্রাক্টর নিয়ে সুরেখাদের বাড়ি আসে। ঘরটিকে ঘিরে ধরে। সুরেখার স্বামী ভাইয়ালাল তখন মাঠে কাজ করছিলেন। হৈ চৈ শুনে তিনি দৌড়ে বাড়ি ফিরলেন। জান বাঁচাতে আশ্রয় নিলেন একটা ঝোপের পেছনে। দেখলেন একটা দঙ্গল তাঁর পরিবারকে আক্রমণ করছে, কারো একার পক্ষে যাদের থামানো সম্ভব নয়।
খাইরলাঞ্জি গ্রামের সবচে নিকটস্থ শহরের নাম দুসালা। ভাইয়ালাল সেখানে পৌঁছলেন। এক আত্মীয়ের সহায়তা নিয়ে পুলিশকে কল করলেন। কিন্তু পুলিশ সেদিন খাইরলাঞ্জি গ্রামে আসে নাই।
দঙ্গলটা সুরেখা, তাঁর মেয়ে প্রিয়াংকা এবং দুই ছেলে সুধীর ও রোশনকে তাঁদের ঘর থেকে টেনে বের করলো।ছেলেদের হুকুম দিলো, নিজেদের মা-বোনকে ধর্ষণ করতে। তাঁরা যখন এই পৈশাচিক হুকুম মানতে অনুমেয়ভাবে অস্বীকার জানালো, তাঁদের যৌনাঙ্গ কেটে নিয়ে খুন করা হলো। সুরেখা আর প্রিয়াংকাকে সম্মিলিতভাবে ধর্ষণ করা হলো। এরপর তাঁদের পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো।
চারজনের লাশই নিকটস্থ খালে ফেলে দেওয়া হয়।
৬.
শুরুতে প্রচারমাধ্যম ঘটনাটিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের অপচেষ্টা চালায়। তারা এটাকে অনার কিলিং হিসেবে প্রদর্শন করে। সুরেখার যে পুরুষ আত্মীয় অতীতে খুন হয়েছিলেন, তাঁর সাথে কাল্পনিক অনৈতিক সম্পর্ক আবিষ্কার করে গ্রামবাসীরা ক্ষুব্ধ হয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে, এমনটা দাবি করে।
দলিত সংগঠনগুলোর তীব্র প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত অপরাধটিকে গুরুত্বের সাথে আমলে নিতে বাধ্য হয় ভারতীয় বিচার ব্যবস্থা৷ নাগরিকদের তথ্যানুসন্ধান কমিটির অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, কীভাবে সাক্ষ্যপ্রমাণ নষ্ট করার চেষ্টা হয়েছিলো।
নিম্ন আদালত মূল অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। যদিও এটা আসলে অপরাধীদের বাঁচানোর একটা কৌশল। কারণ একটা দেশের নিম্ন আদালত যখন সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে ফেলে, তখন উচ্চতর আদালতের পক্ষে সেই শাস্তি কমিয়ে দেয়া খুবই সহজ হয়। কিন্তু এরচেয়েও বড় একটা খেলা এসময় চলছিলো। বিচারক রায় দেওয়ার সময় দাবি করেন, ধর্ষণ ঘটেছে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জাতিভেদ প্রথার সাথেও হত্যাকাণ্ডটির কোন সম্পর্ক নেই। এটা নিছকই একটা প্রতিহিংসামূলক হত্যাকাণ্ড ছিল।
আর এইভাবেই সব দায় কতিপয় অপরাধীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সুকৌশলে দায়মুক্তি দেয়া হয়, অপরাধের ভিত্তি জাতিভেদ প্রথাকে। এই পৃথিবীতে বেইনসাফির চেয়েও জঘন্য কিছু যদি থেকে থাকে, তা হলো ইনসাফ কায়েমের ভণিতা।
৭.
সুরেখা ভূতমাঙ্গে ডটার অফ ইন্ডিয়া হতে পারেননি। তাঁর কন্যা প্রিয়াংকার কপালেও জোটেনি এই আখ্যা। মরণেও তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণির শিকারই রয়ে গিয়েছেন।
“খাইরলাঞ্জি ক্রাইম” নামে কোন বিখ্যাত ওয়েব সিরিজও নেই। হিন্দুত্ববাদের এই জামানায় নওভারতের নির্মাতারা কাশ্মীর আর কেরালার বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাল্পনিক কিংবা অতিরঞ্জিত অন্যায় নিয়ে মেতে আছেন। বিনোদন শিল্পের জীবিত নক্ষত্ররা রামমন্দির দেখতে দল বেঁধে অযোধ্যায় যাচ্ছেন। হিন্দুত্ববাদের যুগে ভারতে জামানা অনেকের জন্যই বদলেছে, কিন্তু দলিতরা এই অনেকের অন্তর্গত নন।
সুরেখাদের দলিত জীবনের দাস্তান যেদিন শুধু সামনেই আসবে না, প্রাধান্য পাবে, সেদিন ভারতে নারী অধিকার রাষ্ট্রশক্তি ও কর্পোরেট শক্তির সীমিত পরিসরের খেলনা থেকে বিপুল অধিকাংশ নারীর জীবন বাস্তবতা হয়ে উঠতে শুরু করবে।
নোট: লেখাটির সব তথ্য ও মূল ভাব ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায়ের The Doctor and The Saint: The Ambedkar-Gandhi Debate Caste, Race and Annihilation of Caste (Haryana: Penguin, 2019) থেকে নেওয়া। তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।