সোমবার, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়প্রীতি উরাংই যেন শেষ জন হয়

প্রীতি উরাংই যেন শেষ জন হয়

“দ্য ডেইলি স্টার” পত্রিকার বাংলা সংস্করণে, ২০২৩ সালে মে দিবসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল এইরকম, “গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতি কেবল কাগজে-কলমে”।

গৃহকর্মকে শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ২০১৫ সালে সরকার “গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫” প্রনয়ণ ও অনুমোদন করে। এই নীতিমালার শুরুর দিকেই সংবিধানের ২০, ২৭ ও ৩৪ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং সার্বজনীন মানবাধিকারের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে সকল প্রকার জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধ করে গৃহপরিচারিকাদের সুরক্ষা, কল্যাণ, অবকাশ, বিনোদন, ছুটিসহ সুষ্ঠু ও মর্যাদাসম্পন্ন কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও, বাস্তবক্ষেত্রে আজও সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতোই অধরা থেকে গিয়েছে এসব।

গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতির কার্যকারিতা নিয়ে এক সময়  প্রশ্ন তোলা পত্রিকারই প্রভাবশালী সাংবাদিক, নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় গত ৬ মাসের মধ্যে দুই দুই জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হোন। একজন পালাতে গিয়ে ভবন থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয়। ফেরদৌসী নামের এই মেয়েটির বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। আর একজনকে গত ৬ ফেব্রুয়ারি নির্যাতন করে হত্যা করে ৯ তলা ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। প্রীতি উরাং নামের এই মেয়েটির বয়স ছিল মাত্র ১৫। দুজনই ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ( বিলস) এর তথ্য বলছে, বাংলাদেশে গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২৫ লক্ষ। এর মধ্যে ৯৫% নারী। তাদের মধ্যে ৬০% আবাসিক এবং ৪০% অনাবাসিক। আবাসিক নারী গৃহকর্মীদের মধ্যে ৬৬% রাতে ঘুমাতে যেতে অনিরাপদ বোধ করেন। বিলসের তথ্য মতে, ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫৭৮ জন গৃহকর্মীকে লাশ হতে হয়েছে। কয়জন ধর্ষিত, নির্যাতিত, হত্যাকাণ্ডের শিকার গৃহকর্মীর খবর পত্রিকার পাতায় স্থান পায়, সেটা নিয়ে যদি বৃহৎ পরিসরে কোন গবেষণা কিংবা জরিপ চালানো যেতো, তাহলে দেখা যেতো পত্রিকায় প্রকাশিত এই সংখ্যা নিতান্তই নগন্য। কেন তারা পত্রিকার পাতায় স্থান পায় না, সেটা বুঝার জন্য বিরাট জ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই। কেবলমাত্র বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একটু আধটু অবগত থাকলেই যথেষ্ট! খেতে, পরতে দিতে না পারা নিতান্ত দরিদ্র পরিবারের শিশু ও কিশোরী মেয়েদেরই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবার আবাসিক গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকে। এই শ্রেণির হাতে শুধু দেশের অধিকাংশ সম্পদ না; ক্ষমতা, আইন, পুলিশ, প্রশাসন সবই তাদের হাতে।

প্রায় ৫০% গৃহকর্মী ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হোন। অথচ এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে গৃহকর্মী হত্যা ও নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিচার পাওয়ার একটি মাত্র উদাহরণই আছে। ২০১৩ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর ১১ বছর বয়সী গৃহকর্মী আদুরীকে নির্যাতন করে ঢাকার পল্লবীর ডিওএইচএস এলাকার একটি ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহানকে আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করে, যে সাজা এখনো সে ভোগ করছে।

এজন্য যে স্বল্প সংখ্যক গৃহকর্মী হত্যা ও নির্যাতনের খবর আমরা পত্রিকার পাতায় পাই, তারাও আইনের আশ্রয় নেন না সবাই। হত্যাগুলোকে বেশির ভাগ সময়ই ‘আত্মহত্যা’ ও ‘দুর্ঘটনায় মৃত্যু’ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। মামলা হলেও স্বাক্ষী, প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক সময় হুমকি, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে পরিবারের সদস্যদের সমঝোতা করতে বাধ্য করা হয়! এই পুরো নাটকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালত, প্রশাসন, নির্যাতক কিংবা হত্যাকারী মঞ্চে প্রধান চরিত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে যায়। নিপীড়ন কিংবা হত্যাকাণ্ডের শিকার যারা হোন, তাদের পরিবার থেকে যায় নিতান্ত পার্শ্বচরিত্রের ভূমিকায়।

আইন, নীতিকথা কারো পেটের ক্ষুধা নিবারন করতে পারে না। তাই যে বয়সে একটা শিশুর প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানোর কথা; বিদ্যালয়, বন্ধু- বান্ধব, আত্মীয়-পরিজনদের নিয়ে মেতে থাকার কথা, সেই বয়সে দারিদ্র্যের শিকার হয়ে শুধু দুমুঠো খাবারের জন্য তারা বহন করছে অন্যের বাড়িতে এক অনিশ্চিত, অমর্যাদাকর ও নির্মম জীবন! সাংবাদিক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় ফেরদৌসীকে নির্যাতনের মামলার সমঝোতা হয়ে গিয়েছিল। এইবারও অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, প্রীতি উরাংকে হত্যার দায় থেকেও হয়তো মুক্তি পেয়ে যাবেন তারা। আবারও হয়তো নতুন কোন শিশু, নয়তো কিশোরী গৃহকর্মী যোগাড় করে নিবেন। এরপর,,,। যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে, আগের বারের মতো হয়তো এতোটা কাঁচা কাজ করবেন না তারা এরপর। গৃহকর্তারা এমনটা দিনের পর দিন ঘটাতে পেরেছে এবং পারছে একটা প্রধান কারণে। সেটা হলো, এতো বিপুল সংখ্যক গৃহকর্মী গৃহ-শ্রমের সাথে যুক্ত থাকলেও তারা বিচ্ছিন্ন, সংগঠিত নন।

একটা অনগ্রসর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেও যে ন্যূনতম নাগরিক অধিকার, আইনের শাসন, মানবিক মর্যাদা থাকে, কিছুদিন পরপর গৃহকর্মী নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড ও বিচারহীনতা, ৫৩ বছরের প্রৌঢ় রাষ্ট্রটি যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দেয়। আরও দেখিয়ে দেয়, এই স্বাধীনতা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী শ্রমজীবীদের জন্য নয়। নারীদের জন্য নয়। গৃহকর্মীদের জন্য নয়। কৃষকের জন্য নয়। আদিবাসীদের জন্য নয়।

কিছুদিন পরপর এক একজন গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হোন। কিছু মানুষ কয়েক দিন হাউকাউ করে। পত্রিকাগুলো, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কিছুটা নড়েচড়ে বসে। এরপর সব ঠান্ডা! আর কতো? আমরা চাই, প্রীতি উরাংই যেন শেষ জন হয়।

প্রীতিদের বাঁচাতে হলে যা তাদের বিদ্যালয়ে না নিয়ে গৃহকর্মী হতে বাধ্য করে, সবার আগে দরকার শৈশবে তাদের সেই গৃহকর্মীর জীবন থেকে অর্থাৎ দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করা। দরকার পুঞ্জিভূত সম্পদ ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, যার বলে নিপীড়ক ও হত্যাকারীরা বারবার পার পেয়ে যায়। দরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা।

রাষ্ট্রের দিকে কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণির দিকে না তাকিয়ে থেকে গৃহকর্মীদের উচিত, জেলাগুলোতে স্থানীয় পর্যায়ে এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নিজেরা সংগঠিত হওয়া এবং নিজেদের অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদা সম্পর্কে উচ্চস্বরে জানান দেওয়া, লড়াই করা।

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাম্প্রতিকা