উৎসর্গ
ঈশিকা জাহান মুন
যাঁর চিন্তাকর্ম আমাকে অনুপ্রাণিত করে, করে ভবিষ্যতমুখী ও আনন্দিত
শিল্প হিসেবে সিনেমার বয়স খুব বেশি নয়। ১৮৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসে প্যারিসে লুমিয়ের ভাইদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল সিনেমা প্রদর্শনী। [১] সেই হিসেবে সিনেমার ইতিহাস শতবর্ষের কিছু বেশি। হোমো স্যাপিয়েন্সের ২ লক্ষ বছর তো বটেই, সভ্যতার ৫ হাজার বছরের তুলনায়ও সময়টাই সামান্যই, মুহূর্তই বলা যায়। মানুষের সময়রেখায় সিনেমার আগমন সেক্ষেত্রে সাম্প্রতিক ঘটনা। যা কিছু ভালো, তা জীবনে দেরীতেই আসে।
কিন্তু এই লেখার উদ্দেশ্য বিশ্ব সিনেমার ইতিহাস ধারাক্রমিকভাবে বর্ণনা করে যাওয়া নয়, নয় কোন সিনেমার সুনির্দিষ্ট পর্যালোচনাও। আমার উদ্দেশ্য খোদ সিনেমা জিনিসটারই সম্ভাবনা দেখানো। যাকে আমি বলি, ‘অতীতের অনন্তায়ন’, তার বিরুদ্ধে।
শুরুতেই ‘অতীতের অনন্তায়ন’কে সংজ্ঞায়িত করে নেয়া দরকার।
সব প্রাণের মত মানুষেরও একটি অতীত আছে। যাকে বলে ইতিহাস। আমাদের সবারই হয়তো তা জানতে ভালো লাগে। কিন্তু এই ইতিহাসের বিশেষ ধরণের চর্চা বিপজ্জনক। যেখানে কোন বিশেষ ইতিহাসকে বা ইতিহাসের বিশেষ কোন পর্বকে প্রচারণার জোরে ‘চরম’, ‘পরম’, ‘আদর্শ’ বলে চালানো হয়। ‘ধর্ম’, ‘জাতি’, ‘চেতনা’, ‘উন্নয়ন’, ‘প্রগতি’, ‘ঐক্য’ ইত্যাদির নামে। এই ধরণের ইতিহাস চর্চার উদ্দেশ্য অত্যন্ত অশুভ। আর পরিণতি মর্মান্তিক। এটা রুদ্ধ করে দেয় সমাজের বিকাশের পথ, আর মানুষকে করে তুলতে চায় তার নিজেরই তৈয়ার ইতিহাসের কারাবন্দী।
আমি এই নেতিবাচক প্রক্রিয়াটিকেই বলি অতীতের অনন্তায়ন।
এর বিপরীত প্রক্রিয়া হিসেবে যদি আধুনিকতাকে দেখি, অবশ্যই পর্যালোচনা সমেতই, তাহলে তার বুদ্ধিবৃত্তিক দিকটার শুরুয়াত সাহিত্য দিয়ে। ১৬০৫ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রকাশ হয়েছিল মিগুয়েল দ্য সারভেন্তেসের এল ইনজেনিওসো হিদালগো দন কিহোতে দে লা মাঞ্চা [২]। আরও অনেকের মত আমিও মনে করি, এটাই প্রথম আধুনিক উপন্যাস, যা তৈরি করেছিল ব্যক্তির বিকাশের সাংস্কৃতিক জমিন।
কিন্তু উপন্যাস পাঠ করতে অক্ষরজ্ঞানের প্রয়োজন হয়, যা অনেকেরই নেই। আজও বহু মানুষ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অশিক্ষিতই রয়ে গেছেন। আর এখানেই সিনেমা বিশেষভাবে হয়ে ওঠে সম্ভাবনাময়। লিখতে-পড়তে জানেন না, এমন মানুষও উপভোগ করতে পারেন একটি সিনেমা। যেহেতু কাজ করে তাঁদের দৃষ্টি ও শ্রুতি। তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষেরাও সিনেমা দেখতে খুবই ভালোবাসেন। কারণ এটা সেই পৃথিবীতে প্রবেশাধিকার তাঁদের দেয়; প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যার পথে ফেলে রেখেছে বিশাল বিশাল পাথর।
এখন, সম্ভাবনা বলতে আমি ঠিক কী বুঝাচ্ছি?
সম্ভাবনা হচ্ছে অতীতের অনন্তায়নের ঠিক বিপরীত প্রক্রিয়া। যেখানে অতীতের অনেক কিছুই বাছবিচার করে রাখা হবে, আবার অনেককিছুই স্রেফ ফেলে দেয়া হবে। যেখানে কিছুই ‘চরম’, ‘পরম’, কিংবা ‘আদর্শ’ নয়। যে কোন ব্যবস্থা, বিশ্বাস কিংবা রীতিনীতিই যেখানে সময় (ইতিহাস) ও স্থানের (ভূগোল) প্রতিফলন মাত্র ; ‘শ্বাশ্বত’ কিছু নয়।
অতীতের অনন্তায়নে ব্রতীরা যেসব গল্প বলে, সেগুলো স্রেফ গল্প। কোন সময়হীন সত্য নয়। সিনেমা সম্ভাবনা রাখে নতুন গল্প বলার। আর তার ভেতর দিয়ে গল্পকথনের ওপর অতীতের অনন্তায়নে ব্রতীদের একচেটিয়ার অবসানের। আজকে একশ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে অনেক নির্মাতাই এই চেষ্টা চালিয়ে এসেছেন, আর পড়েছেন ক্ষমতাশালীদের রোষানলে। আন্দ্রেই তারকোভস্কিকে একটা পাঠ্যবই উদাহরণ বলা যায়। আমরা আরও স্মরণ করতে পারি, ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্রে নানান সময়ে রাষ্ট্রশক্তির হাতে দমন পীড়নের শিকার হওয়া জাফর পানাহি কিংবা মারইয়াম মোকাদামের কথা। হ্যাঁ, লেনি রিফেনস্টালরা ছিলেন, সম্ভবত সবসময়ই থাকবেন। কিন্তু এই দুনিয়ায় সবাই বিকিয়ে যায় না।
এই অর্থেই সিনেমার নাম দিয়েছি ‘আধুনিকতার ধর্ম’।
অতীতের অনন্তায়নে ব্রতীরা সিনেমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। সিনেমাজড়িত মানুষদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুৎসা রটায়। এটা কোন ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত ব্যাপার নয়। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার, যার ভিত বস্তুগত বাস্তবতা। তাদের আসল ভয় সংস্কৃতির বাজারে একচেটিয়া হারানোর। তারা জানে, নতুন গল্প যে নতুন বাস্তবতা তৈরি করার সামর্থ্য রাখে, তা পুরনো পৃথিবীটা ভেঙেচুরে ফেলতে পারে। নতুন একটা দুনিয়ায় তারা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে, পড়বে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। এই আশঙ্কা থেকেই তারা পরিবর্তন ভয় পায়।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে এর একটা বিখ্যাত উদাহরণ আছে।
১৮৮৫, ১৮৮৭, ও ১৮৯১ সালে তিন ভাগে প্রকাশিত হয়েছিল মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু [৩]। কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা হলেও এই উপন্যাসের ঐতিহাসিক বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে সমালোচনা আছে। কিন্তু জনসমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করলেও এই উপন্যাস নিয়ে অতীতের অনন্তায়নে ব্রতীরা যে অস্বস্তিতে থাকে, তার কারণ উপন্যাসটি কারবালার জানা ঘটনাটাই নতুন করে বলে একচেটিয়া ভেঙে দিয়েছিল।
হোসেন ‘মূলধারার ইতিহাস’ থেকে নিয়েছিলেন কিছু উপাদান, তারপর তাতে মিশিয়েছিলেন নানান লোকজ বিশ্বাস। ফলে, তিনি বলতে পেরেছিলেন একটি নতুন গল্প। আধুনিকতা এভাবেই কাজ করে, সম্ভাবনার বিকাশ ঘটায়।
‘আধুনিকতার ধর্ম’ হিসেবে সিনেমার কাজও ঠিক তাই। নতুন গল্প বলা। ক্যামেরার ভাষা দিয়ে ও নানাবিধ সৃষ্টিশীল রীতিতে। ইতিহাসে বহু নির্মাতাই সেই সাধনা করে গেছেন। আজও করে চলেছেন। বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতাদেরও এই পথেই হাঁটতে হবে। সম্ভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে ভবিষ্যৎ রচতে হবে। তৈরি করতে হবে সেই সাংস্কৃতিক জমিন, যা বৃহত্তর সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতার ইতিবাচক পরিবর্তনে বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা রাখবে।
তথ্যসূত্র
[১] “A very short history of cinema | National Science and Media Museum” https://www.scienceandmediamuseum.org.uk/objects-and-stories/very-short-history-of-cinema
[২] “Groundbreaking novel “Don Quixote” is published | January 16, 1605 | HISTORY” https://www.history.com/this-day-in-history/don-quixote-novel-first-published
[৩] “বিষাদ-সিন্ধু – বাংলাপিডিয়া” http://bn.banglapedia.org/index.php?title=%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A6%A6-%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A7%81