সন্তান লালন পালনের নামে আমরা সন্তানের অনেক স্বাভাবিকতা ধ্বংস করে দিচ্ছি, নিজেদের অজান্তেই। আমরা বেশির ভাগই মনে করি, ভালো খাওয়ালে, ভালো পোশাক পরালে আর নিজের মতো, মানে অভিভাবকের ছাঁচ মতো করে বেড়ে ওঠালেই বাচ্চার মঙ্গল হয়। তাদের খাওয়া-পরা-খেলা সব জায়গায়তেই আমরা আমাদের নিয়ম কঠোরভাবে বলবত করি। শিশুর স্বাধীন সত্তাকে আমরা অস্বীকার করি। শিশু ভালো-মন্দ কিছুই বুঝে না ঠিকই। কিন্তু তাকে সম্মান করে, তার স্বাধীন সত্তাকে স্বীকার করে, ছোট্ট বয়স থেকেই আমরা শান্ত থেকে ঠান্ডা মাথায় ভালো- মন্দ শেখাতে পারি। কোন রকম জোর-জবরদস্তি না করেই। খাবার টেবিলে তার নিজ পছন্দে, নিজের হাতে খাবার খেতে সাহায্য করতে পারি। দেখা যায়, বাচ্চার আগে আমরাই অধৈর্য্য হয়ে যাই। তাই জোর করে গেলাতে গিয়ে তার পছন্দ- অপছন্দ, তার নিজ হাতে খাওয়ার ইচ্ছাকেও অসম্মান করি।
আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত পরিবারের বড় বড় ছেলে-মেয়েরাও নিজ হাতে খেতে পারে না। নিজের পোশাক নিজে ঠিক মতো পরতে পারে না। পোশাক পরিষ্কার করা, খাবার তৈরি করা তো অনেক দূরের কথা। একটা বাচ্চা যার বয়স ১৬ বছর, সে তো না খেয়ে ১৬ হয়নি। পোশাক না পরে হয়নি ১৬ বছর। এই কাজগুলো নিশ্চয়ই কেউ না কেউ করে দিয়েছেন। যিনি এইসব কাজ করে দিয়েছেন, তিনি শিশুকে ভালোবেসেই করেছেন। কিন্তু এই ভালোবাসা বাচ্চাকে আজীবনের জন্য আত্মবিশ্বাসহীন করে দিয়েছে। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। করেছে পরনির্ভরশীল। এক কথায় পা থাকা অবস্থায় পঙ্গুই করে দিয়েছে।
কিন্তু দুই বছর বয়স থেকেই শিশুর স্বাধীন সত্তার বিকাশ হয়। যার ফলে সে তার সব কাজ নিজে করার জন্য উদগ্রীব হয়। অভিভাবকদের অতিরিক্ত ক্ষতিকর ভালোবাসা তার এই প্রকৃতি প্রদত্ত স্বাভাবিক ক্ষমতাকে ধ্বংস করে তাকে পঙ্গু করে দেয়। সে শুরুতেই পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
আমার মেয়ের বয়স দুই বছর। তাকে দেখে আমি অনেক কিছু ভাবছি। সে খুব অল্প খায়। খুব অল্প, কিন্তু ইদানিং যা খায় নিজের হাতে খেতে চায়। কাপড় পরাতে গেলে দুই হাত এগিয়ে দিবে। নিজে নিজে জুতা পরার চেষ্টা করে। দাঁত ব্রাশ নিজে করতে চায়। এমনকি তার পছন্দের পোশাক সে পরতে চায়। বাক্য গঠন করে বলতে না পারলেও হাত দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এই পোশাকটা পরবে না, অন্যটা পরবে। আসলে এই বয়সের সব সুস্থ বাচ্চাই, একই আচরণ করে। কিন্তু আমরা ঘর নোংরা করবে, নিজ হাতে কম খাবে, পেট ভরবে না, দাঁত ঠিকমতো পরিষ্কার হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি মনে করে তাদের দিনে দুইবারও নিজের কাজ নিজে করার সুযোগ দেই না। তাই তারা ধীরে ধীরে পরনির্ভরশীল হতে বাধ্য হয়।
ঘরে কাজ করা মা আর বাইরে কাজ করা মা, উভয়ের জন্যই সন্তান লালন পালন শ্রমসাধ্য, ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর আবার আনন্দদায়কও বটে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ন্যাচারের পক্ষে থেকে বাচ্চাকে ট্রেইন আপ করলে হয়তো সন্তানের ভবিষ্যত এবং আমাদের প্যারেন্টিং জার্নিটা সন্তানের জন্য সুদূরপ্রসারী ও মঙ্গলজনক হবে বলে আমার মনে হয়।