উচ্চ আদালত থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, দেশের ৬৪ জেলায় ৯৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মোট বিচারাধীন মামলা ছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ২১৮টি। এসব মামলার ৫২ শতাংশই ছিল ধ//র্ষ//ণে//র। আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর সরকার ধ//র্ষ//ণে//র সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করে। সাজা বাড়ালেও ধ//র্ষ//ণে//র ঘটনা কিন্তু কমেনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সারাদেশে নারীর উপর ঘটে চলা ধ//র্ষ//ণ, যৌন হয়রানি, বেশ্যাকরণ ইত্যাদির ঘটনা বেড়েই চলেছে। কয়েক দিন আগেও ফাইরুজ অবন্তিকা নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক ছাত্রীকে সংঘবদ্ধভাবে সহপাঠী-প্রক্টর মিলে যৌ//ন হয়রানি ও বেশ্যাকরণের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে না পেরে আ//ত্ম//হ//ত্যা//র আশ্রয় নিতে হয়েছে।
নারীর সাথে ঘটে চলা এসব অপরাধের পিছনে আমরা অপরাধীর ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও অপরাধের শিকার নারীর প্রতি সমাজের নেতিবাচক মনোভাব জারি থাকাকে মূল কারণ হিসেবে মনে করি। অথচ উল্টোটা হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল অপরাধীর জনসম্মুখে মুখ দেখাতে না পারার, সম্মানহানি ঘটার! বিপরীতে অপরাধের শিকার নারীর প্রতি সমাজের এই নেতিবাচক মনোভাব জারি রাখতে রাষ্ট্রের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো, আইন, আচরণ, নীতিমালা, মনোভাব প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে নানানভাবে। এর আগে একটি লেখায় রাষ্ট্র কীভাবে সমাজের এই নেতিবাচক মনোভাব জারি রাখতে ভূমিকা পালন করে, সেসব নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি। আজকের লেখায় তাই আর সেদিকে যাবো না। রাষ্ট্রের করা আইন, নীতিমালা, কাঠামো, আচরণ, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের এই নেতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে যেহেতু ভূমিকা রাখে। তাই এসব পরিবর্তনের পাশাপাশি সমাজের নেতিবাচক মনোভাব পরিবর্তনের দায়িত্বও রাষ্ট্রকেই নিতে হবে সর্বাপেক্ষা কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে। আজকে রাষ্ট্রের সেই সর্বাপেক্ষা কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েই আলাপ করতে চাই।
১০ অক্টোবর ২০২২, রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে কন্যাশিশু দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন:
“যতোক্ষণ পর্যন্ত সমাজ মনে করবে— ধ//র্ষ//ণ হলে সম্ভ্রমহানি ঘটে, ততোক্ষণ পর্যন্ত ধ//র্ষ//ণ চলতে থাকবে। এটা একটা হাতিয়ার হিসেবে কেউ না কেউ ব্যবহার করবে। যুদ্ধে ব্যবহার করবে, স্বাভাবিক অবস্থায় ব্যবহার করবে, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ব্যবহার করবে, পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের ক্ষেত্রে ব্যবহার করবে।”
সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য ও গবেষণায় পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ধ//র্ষ//ণে//র শিকার নারীর প্রতি বিদ্যমান সমাজের নেতিবাচক মনোভাব নারীকে ও তার পরিবারকে কাবু করার জন্য যুগ যুগ ধরে ধ//র্ষ//ণ//কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার বাস্তবতা তৈরি করে আসছে। ১৯৭১ সালে পাক বাহিনী আমাদের মা বোনদের উপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে অনেকটা এই সামাজিক মনস্তত্ত্ব থেকেই। এর ক্ষত ও পরিণাম আজও আমরা বহন করে চলেছি। তাই ধ//র্ষ//ণ প্রতিরোধ করতে হলে সবার আগে ধ//র্ষি//তা নারীর প্রতি সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। সমাজের সর্বস্তরে এই উপলব্ধি ছড়িয়ে দেয়া দরকার যে, কুকুরে কামড় দিলে যেমন সম্ভ্রম চলে যায় না, তেমনি ধ//র্ষ//ণে//র শিকার হলেই কিংবা কেউ বে//শ্যা বললেই নারীর সম্ভ্রম/ সম্মান চলে যায় না। নারীর সম্ভ্রম তার বিশেষ কোন অঙ্গে লুকায়িত থাকে না।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের প্রেরণা। এই যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনতে ৩০ লাখ মানুষকে শহীদ হতে হয়েছে। পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নির্মম নি//র্যা//তন-অপমান-ধ//র্ষ//ণের শিকার হতে হয়েছে প্রায় দুই লক্ষ নারীকে। যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, তাদের চেয়ে যেসব নারী যুদ্ধ চলাকালে হানাদার বাহিনীর দ্বারা নির্মম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের ত্যাগ ও অবদান কোন অংশে কম নয় বাংলাদেশ নামক দেশটির নামজারি প্রতিষ্ঠা করতে।
যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন স্বাধীনতার পর তাদের সনদ দিয়ে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছ। একসময় তাদের চাকুরি, ভাতা এবং সন্তান- নাতি- নাতনীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও চাকুরিক্ষেত্রে বিশেষ কোটার সুবিধাও দেয়া হয়েছে। বর্তমানে কিছু ক্ষেত্রে সন্তান ও নাতি-নাতনীদের কোটার সুবিধা রহিত করা হলেও, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা আগেরই মতো বলবত রাখা হয়েছে।
কিন্তু সেই সব নির্যাতিত নারীরা দীর্ঘ প্রায় ৪৫ বছর না পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি, না পেয়েছেন ভাতা ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা। নির্যাতিত নারীদের একটা অংশ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর লজ্জায় গ্লানিতে আত্মঘাতী হয়েছেন। একটা অংশ পরিবার- সমাজ- সংসারে ঠাই না পেয়ে ভাসমান মানবেতর জীবন বেছে নিয়েছেন। কেউ কেউ শিকড়ের মায়া ভুলে বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। একজন মানুষ হিসেবে স্বাভাবিক জীবন যাপন করার অধিকার ও সুযোগ তাদের মধ্যে খুব কম জনই ফিরে পেয়েছেন।
অনেক দেরিতে হলেও রাষ্ট্র ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সাথে বলতে হচ্ছে , ‘বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা’ প্রদানের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে তাদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব দেওয়া হলেও এবং পরবর্তীতে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অনেককেই স্বীকৃতি দেয়া হলেও, রণাঙ্গনে অংশ নেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মতো তাদের নাগরিক জীবনের কোথাও গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে সামনে নিয়ে আসা হয়নি, প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি, স্মরণীয় করে রাখার জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়নি! অনেক জায়গায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে বিভিন্ন জায়গা, প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামকরণ করে তাদের বিশেষ সম্মাননা জানানো হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোথাও কোন নির্যাতিতা নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা( বীরাঙ্গনা)র নামে কোন কিছুর নামকরণ হয়েছে বলে জানা নেই।
২০১৯ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর সারাদেশে জেলা পর্যায়ের সরকারি কলেজগুলোতে নারী ছাত্রীদের জন্য ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণ করেছে। দুই বছর আগে আমরা ‘নারী অঙ্গন’ থেকে সেগুলোর নামকরণ বীরাঙ্গনাদের নামে নামকরণের জন্য দাবি জানিয়েছিলাম। একইসাথে সারাদেশে প্রত্যেকটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ চলমান আছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নামকরণও স্ব স্ব জেলার নির্যাতিত এবং এখনো জীবিত আছেন এমন নারী বীর মুক্তিযোদ্ধার (বীরাঙ্গনার) নামে নামকরণের জোরালো দাবি ও প্রস্তাব রেখেছিল ‘নারী অঙ্গন’।
এই নামকরণ মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিবে এবং দীর্ঘ দিনের অপমান-বঞ্চনা-অভিমান-অন্তর্জ্বালা কিছুটা হলেও লাঘব করবে। একইসাথে নারীর উপর যৌন নিপীড়ন ও হয়রানি চালিয়ে নারীর চলার পথকে যে থামিয়ে কিংবা শেষ করে কিংবা তাদের সমাজের প্রান্তে ছুঁড়ে ফেলা যায় না, এই বার্তাও দেয়া হবে জনমানসকে। বার্তা দেয়া হবে, ধ//র্ষ//ন নারীর উপর ঘটে যাওয়া শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ছাড়া আর কিছুই না। এতে নারীর সম্ভ্রম/সম্মান/সতীত্ব চলে যাওয়ার কিছুই নেই।
তাই এখনো প্রতিদিন যেসব নারী বিভিন্ন কারণে পুরুষের দ্বারা যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির শিকার হয়ে আত্মঘাতী হোন কিংবা অসম্মানিত বোধ করেন, তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে এবং এই ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এই উদ্যোগ জরুরি। আজকের দিনে পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা ও আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলেও নতুন দেশের জন্মক্ষণে যারা নির্মম যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা অত্যন্ত জরুরি।
বীরাঙ্গনাদের যথাযথ সম্মান ও সুযোগ সুবিধা দিয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারাটাকে আমরা এই রাষ্ট্রের আদি-ভুল বলে মনে করি। প্রতিদিন নারীর উপর ঘটে চলা যৌ//ন নি//র্যাত//ন ও বে//শ্যা//করণের ষড়যন্ত্র দূর করতে এই আদি-ভুলের মীমাংসা জরুরি। জরুরি সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করা। সেজন্য শুধু মুখে মুখে কিংবা সনদ দিয়ে নয়, কাজেও সম্মানিত করা সবার আগে প্রয়োজন বলে ‘নারী অঙ্গন’ মনে করে। এজন্য নির্যাতিত নারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের (বীরাঙ্গনাদের) নামে নব নির্মিত ছাত্রী হল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্থান ও স্থাপনার নামকরণের মাধ্যমে এই কার্যক্রমের সূচনা হতে পারে, যা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে।