বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪
Homeঅর্থকড়ির জগৎবাল্যবিবাহ: অতঃপর যা ঘটতে পারে...

বাল্যবিবাহ: অতঃপর যা ঘটতে পারে…

দেশে বাল্যবিবাহ শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরীব সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি-২০২৩, অনুযায়ী ২০৪টি দেশের মধ্যে বাল্যবিবাহের হারের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৫ম এবং এশিয়ায় ১ম। ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ জনমিতি ও জনস্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস)-২০২২ এর প্রতিবেদন এবং
বাল্যবিবাহের প্রবণতা ও কারণ খুঁজে বের করতে ২০২৩ সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসে দেশের ২৭টি জেলার ২ হাজার ৮০ গ্রামের ৫০ হাজার পরিবারের উপর ব্র‍্যাক পরিচালিত একটি জরিপেও প্রায় একই তথ্য ওঠে আসে। ব্র‍্যাকের জরিপে ১৮ বছরের আগে, না পরে –কখন মেয়েদের বিয়ে দেওয়া প্রয়োজন? এই প্রশ্নের জবাবে ৫০ শতাংশ অভিভাবক আগে এবং ৫০ শতাংশ ১৮ বছর বয়সের পরে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া উচিত বলে মতামত দিয়েছেন। জরিপ হওয়া ২৭টি জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ বাল্যবিবাহের হার ছিল পিরোজপুর জেলায়, ৭৩ শতাংশ। এরপর চাপাইনবাবগঞ্জে, ৬৫ শতাংশ। সবচেয়ে কম নেত্রকোনা জেলায়, ২৪ শতাংশ। এই জরিপ থেকে আরও জানা যায়, দেশের ৭০ শতাংশ কিশোরী বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে।

এতোদিন বাল্যবিবাহের জন্য দরিদ্রতা, সামাজিক নিরাপত্তাবোধের অভাব, অশিক্ষা ইত্যাদি যেসব কারণকে চিহ্নিত করা হতো, জরিপে এগুলো প্রধান কারণ হিসেবে ওঠে আসেনি। ৪৪ শতাংশ বাল্যবিবাহ হয়েছে ‘উপযুক্ত পাত্র’ পাওয়ায়। স্বচ্ছল পরিবারেও বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ। বাল্যবিবাহের শিকার নারীদের জন্য বাল্যবিবাহ ভালো কোনো পরিণাম নিয়ে আসে না সাধারণত। শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ইত্যাদি নানাবিধ ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয় তাদের প্রায়শই।

ইউএনএফপিএ জানায়, ২০২০ ও ২০২১ করোনা মহামারির দুই বছরে বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের ৭৬ শতাংশ আর বিদ্যালয়ে ফিরেনি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি)- র এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে ১১ হাজার ৬৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়। ওই ছাত্রীরা বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। অর্থাৎ তারা বিদ্যালয় থেকে পুরোপুরি ঝরে পড়েছে চিরদিনের জন্য, (তথ্যসূত্র: মানবজমিন, ৪ অক্টোবর, ২০২২)। বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরীরা খুব কমই পরবর্তীতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে, চালিয়ে যায়। একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ চালিয়ে গেলেও বাচ্চা, সংসার সামলিয়ে বলার জন্য, সান্ত্বনার জন্য নামকাওয়াস্তে কেবল সার্টিফিকেটসর্বস্ব ডিগ্রি অর্জন করে। এক্ষেত্রে দুই চারটা ব্যতিক্রম অবশ্য থাকে।

‘উপযুক্ত পাত্র’ পেয়ে যাওয়ায় অভিভাবকরা তাদের কিশোরী কন্যাদের উপযুক্ত হয়ে গড়ে ওঠার আগেই বিয়ে দিয়ে একটা অজানা ও অচেনা পরিবেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এটা বর্তমানে তো বটেই, ভবিষ্যতেও তাদের কন্যাদের জন্য কতোটা নির্মম আর কঠিন হতে পারে, তাদের সেটা ভেবে দেখতে হবে। দরিদ্র পিতা-মাতা হয়তো কন্যাদায় থেকে মুক্তি পেতে এমনটা করেন। কিন্তু স্বচ্ছল অভিভাবকরা? তারা তো মেয়ের ‘মঙ্গল’ এর কথা ভেবেই বাল্যবিবাহের কথা ভাবেন। তারা ভাবেন, এতেই তাদের সন্তানের মঙ্গল নিহিত রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে স্বচ্ছল পরিবারে ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিলেও, পদ্মপাতার পানির মতো নড়বড়ে এই জীবনে কোন কিছুরই কিন্তু গ্যারান্টি নেই। না গ্যারান্টি আছে মানুষের জীবনের, না আছে সদাচঞ্চল মনের স্থিরতার।

আত্মপরিচয় আর আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকার কথা না হয় বাদই দিলাম, আগামীকাল কী ঘটতে যাচ্ছে আমরা কেউই কিন্তু জানি না। আপনার কন্যাটি যতোই সুন্দরী হউক, লক্ষীমন্ত হউক, কোনোই গ্যারান্টি নেই কিন্তু অতিশয় ভালো জামাইটি অন্য নারীর দিকে হাত বাড়াবে না, সেই ব্যাপারে। কিংবা স্বামীর ঘরে চরম নির্যাতনের শিকার হবে না, সে ব্যাপারেও। অর্থাৎ কন্যাটি স্বামীর ঘরে নির্যাতনের শিকার হতে পারে, বিয়ে ভেঙে যেতে পারে, বর অন্য কোথাও সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে পারে, মারা যেতে পারে, অসুস্থ হয়ে স্বামী বিছানায় বছরের পর বছর পড়ে থাকতে পারে। এইরকম অনেক কিছুই ঘটতে পারে তাদের জীবনে। তখন?

বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তিরা জীবনে ঘটতে পারে, এমন যেকোনো পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার জন্য নিজেদের সবসময় প্রস্তুত রাখেন। কয়েক দিন আগে আলাপ হলো ৩ ভাই বোনের মধ্যে বড় সন্তান, পিতৃহীন রুনার সাথে, যার মা একজন গৃহিণী। রুনা জেলা শহরে একটা NGO-তে কাজ করতেন। আরও ভালো একটা চাকুরি হয়ে যাওয়ায়, আগের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় নতুন চাকুরিতে যোগদান করেছেন। কিন্তু চাকরি বাকরি তার ভালো লাগতো না। এখনো যে ভালো লাগে, তাও কিন্তু না। সংসার-স্বামী-সন্তান-পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবন কাটাতে ভালো লাগে তার।

যৌথ পরিবারে সন্তান লালন পালনের জন্য মায়েদের তেমন একটা ভাবতে হতো না। পুঁজিবাদের প্রসারের সাথে সাথে যৌথ পরিবার কাঠামো ভেঙে গিয়েছে, জন্ম নিয়েছে একক পরিবার কাঠামোর। নারীরাও পড়াশোনা করছে, অনেকেই কাজ করছে অফিস-আদালত, শিল্প-কলকারখানায় । কিন্তু রন্ধনশিল্প শিল্প হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার মতো আমাদের দেশে পুঁজিবাদ এখনো এতোটা বিকশিত হয়নি। অবিকশিত পুঁজিবাদ সামন্তীয় ও পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিলোপ ঘটাতে পারেনি, যার প্রতিচ্ছবি প্রতিদিন আমাদের পরিবারগুলোতে দেখতে পাই। বাচ্চা লালন পালনের জন্য সুসংগঠিত ডে-কেয়ার সেন্টারও গড়ে ওঠেনি সারাদেশে। এর ফলে একক পরিবারে একজন কর্মজীবী নারীকে একজন কর্মজীবী পুরুষের চেয়ে প্রায় ২ গুন কাজ বেশি করতে হচ্ছে। অফিসের কিংবা কারখানার কাজের বাইরেও সন্তান জন্মদান, লালন-পালন, পরিবারের সদস্যদের টেক কেয়ার, রান্নাবান্না ইত্যাদিও তাদেরকেই করতে হয় সাধারণত। এইরকম কাজের বোঝা বহন করে জীবন কাটাতে কারই বা ভালো লাগে? অবশ্য এই অবস্থা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। কিছু কিছু পুরুষ বাচ্চার দেখাশোনা এবং ঘরের কাজেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

ডিগ্রী পরীক্ষার পর দেখতে শুনতে ভালো সংসারী রুনার তাই বিয়ে হয়ে যায়। পেয়ে যান চাকুরি করতে হবে না এমন কাঙ্ক্ষিত পাত্র এবং কাঙ্ক্ষিত সংসার। বছর ছয়েক সংসার তার বেশ ভালোই চলছিল, স্বামী আর দুই ছেলেকে নিয়ে পরিবার পরিজনদের সাথে। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করেন, স্বামী তার অন্য কোথাও সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছেন। এক পর্যায়ে স্বামীও সেই সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। শেষ পর্যন্ত সংসার টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিলেন রুনা। দুই ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এমনকি সতীনের সাথেও সংসার করতে রাজি ছিলেন। কিন্তু স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে ঘরে নতুন বউ নিয়ে আসে। রুনা বিয়ের পর মাস্টার্স কমপ্লিট করে নিয়েছিলেন। এখন ভালো না লাগলেও বেঁচে থাকার তাগিদে রুনা চাকরি করেন। তবে এই চাকরিই তাকে বেঁচে থাকার জন্য পায়ের তলায় মাটি যুগিয়ে দিয়েছে।

তখন ক্লাস এইটে কি নাইনে পড়ি। রঙিন প্রজাতিরর মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে ইয়াসমিন আপা গ্রামে থাকবেন বলে ঢাকা থেকে চলে এসেছেন। সাথে ঢাকার বাসার বড় রঙিন টিভিটাও নিয়ে এসেছেন। তখন আশেপাশে কারো বাড়িতেই টিভি ছিল না। আমাদের সে কী আনন্দ! একেতো বয়সের পার্থক্য, তার উপর বুঝ হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় এবং কালেভদ্রে বাড়িতে আসতেন বলে ইয়াসমিন আপার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হতো একেবারেই কম। তাও দূর থেকে। আসলে ঢাকায় থাকা বড়লোক ব্যাংক কর্মকর্তা স্বামীর সংসার ছেড়ে তখন দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়িতে ভাইয়ের সংসারে এসে উঠেছেন চাচাতো বোন ইয়াসমিন আপা। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায়, এসএসসির পর নিজেদের পছন্দে বিয়ে করা আপার তখন চলছে ভাসমান জীবন, ভাসমান সংসার। বছর খানেক বাড়িতে থেকে আবার ঢাকায় ফিরে গিয়েছিলেন। এরপর ঢাকায় বড় বোনের কাছেই ছিলেন ২০২১ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। ৫ বোন ১ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট, সবচেয়ে রূপবতী, বোনদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো জায়গায় বিয়ে হওয়া ইয়াসমিন আপাকে ডায়াবেটিস, গুরুতর কিডনি সমস্যায় ভোগে সবার আগে কাবু হয়ে আমাদের থেকে চীরতরে চলে যেতে হয়েছে। আপার যদি পড়াশোনাটা কমপ্লিট থাকতো, কিংবা ছেলে মেয়েদের নিয়ে বেঁচে থাকার মতো একটা চাকুরি থাকতো, তাহলে আপার লড়াইটা নিস:ন্দেহে আরও সহজ হয়ে যেতো। আপাকে ছেলে মেয়ে নিয়ে কখনো ভাইয়ের সংসারে, কখনো বোনের সংসারে গিয়ে আশ্রয় নিতে হতো না।

লিপি আপা। ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠার পরপরই বিয়ে হয়ে যায় চা শিল্পে কাজ করা সুপাত্রের সাথে। এরপর নিজের পড়াশোনা, বাচ্চা, সংসার,,, দুই হাতে সামলেছেন। এইভাবে এসএসসি, এইচএসসি ও ডিগ্রী পাশ করেছেন এবং দুই ছেলে মেয়েকে লালন পালন করেছেন। এক সময় স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে জনিত কারনে স্বামীর তালাকের মধ্য দিয়ে ১৭ বছরের সংসারের সমাপ্তি ঘটে তার। দ্বিতীয় বিয়ের পরও ছেলে মেয়ের কথা ভেবে কোন রকম দাম্পত্য সম্পর্কহীন অবস্থায় প্রায় ৬ বছর স্বামীর এলাকায় স্বামীর সংসারে ছিলেন। এখন বাপের দেশে আলাদা ছোট্ট একটা বাসায় দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে জীবন-তরী পারি দিচ্ছেন। সেখানে পারিবারিক ব্যবসায় দেখাশোনা করছেন।

এসএসসি পরীক্ষার পর জেলা শহরে বড় চাকুরে সুপাত্রের সাথে বিয়ে হয়ে যায় দূর গ্রামের মেয়ে তাজরিন আপার। ১৩ বছরের সুখী দাম্পত্য জীবনের সমাপ্তি ঘটে ১৮ সালে স্ট্রোক করে হঠাৎ স্বামীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। তখন তাজরিন আপার বয়স কতো হবে আর! বড়জোর ৩০ বছর! অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা আপার বাবা চেয়েছিলেন দুই নাতি-নাতনিসহ মেয়েকে গ্রামে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে। কিন্তু বিচক্ষণ তাজরিন আপা শহর ছেড়ে গ্রামে সৎ মায়ের সংসারে বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকার বন্দোবস্তোতে সায় দেননি। শাশুড়ির সাথে স্বামীর ভিটেতেই থেকে গিয়েছেন। ঢাকায় থাকা দেবর সংসারের যাবতীয় খরচ বহন করেন। এরপরও আপা দেবরের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে বসে থাকেননি। ঘরে বসে মজাদার সব কেক, পিঠা, বিভিন্ন খাবার তৈরি করে হোম ডেলিভারি দেন। খুবই আগ্রহ নিয়ে ও আনন্দের সাথে আপা কাজটা করেন। স্বামী, শ্বশুর- শাশুড়ি সবার আগ্রহে বিয়ের পর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এইচএসসি ও ডিগ্রী পাশ করেছিলেন। এরপরও এখন তাজরিন আপার আফসোস, “লেখাপড়াটা যদি ঠিকঠাক মতো করতাম, তাহলে অন্তত প্রাইভেট চাকুরি হলেও করতে পারতাম।” পোড়খাওয়া তাজরিন আপা সেজন্য পড়াশোনায় কিছুটা অমনোযোগী এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়েকে আত্মীয় স্বজনরা বিয়ে দিয়ে দিতে বললেও মেয়েকে শেষ পর্যন্ত পড়ানোর ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আপা মেয়ের ব্যাপারে এতো সহজে হাল ছেড়ে দিতে রাজি নন। মেয়ে পড়তে চাইলে প্রয়োজনে বিদেশেও পাঠাতে রাজি আছেন।

তাজরিন আপা তাও তো স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর পরও ছেলে মেয়েকে নিয়ে স্বামীর বাড়িতে থাকতে পারছেন। এবং ছেলে মেয়ে নিয়ে একাকী জীবন সংগ্রামে দেবর ও শাশুড়িকে পাশে পেয়েছেন। কিন্তু যারা ছেলে মেয়ে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে থাকার সুযোগ পান না? এবং শ্বশুর বাড়ি, বাপের বাড়ির কারো সহযোগিতা পান না, তাদের? তাদের অবস্থাটা কেমন হয়, একবার ভেবে দেখুন। পরিচিত এবং কাছের এক ছোট ভাই হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যাওয়ার পর ছেলে নিয়ে বউকে তার নিজের বানানো বাড়িতে পর্যন্ত থাকতে দেওয়া হয়নি। অথচ সেই ছোট ভাইটি ভাইদের পড়াশোনার খরচ থেকে সংসারের যাবতীয় খরচ চালাতেন। কষ্ট করে চলা দরিদ্র বাবার কাছে ছেলেকে নিয়ে চলে যেতে হয়েছে অল্প বয়সী বউটিকে।

এছাড়া ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে সংসারের হাল ধরার মতো অবস্থায় পৌঁছার আগেই, স্বামী যদি দুর্ঘটনাজনিত কারণে কিংবা অসুস্থ হয়ে বছরের পর বছর বিছানায় পড়ে থাকতে বাধ্য হোন, তখন? তখন তো স্বামী সন্তানের সব দায়-দায়িত্ব মেয়েটিকেই নিতে হবে। কিন্তু মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর না হলে কীভাবে নিবে সে দায়িত্ব? কিংবা ৪ ছেলে মেয়েকে শহরে রেখে পড়াতে গিয়ে স্বল্পশিক্ষিত শাহিনূর ভাবীর মতো মনে হতে পারে, গ্রামের ছোট ব্যবসায়ী স্বামীর পাশাপাশি নিজেও যদি কিছু একটা করতে পারতেন! তাহলে এতোটা কষ্ট হতো না চলতে ফিরতে, ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করাতে! তার ব্যবসায়ী দেবর ও চাকরিজীবী জা মিলে সবকিছু সুন্দরভাবে সামলে জেলা শহরে জায়গা জমিও করেছে। অথচ ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য উনার স্বামীকে গ্রামের জমি বিক্রি করতে হচ্ছে।

আমাদের ইয়াসমিন আপার সিনেমার যেকোনো নায়িকাকে হার মানানোর মতো সৌন্দর্য ছিল। ছেলে মেয়ে দুটোও আপারই মতো হয়েছিল। কিন্তু সুন্দরী বউ, মিষ্টি দুটো বাচ্চা, দুলাভাইকে ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। একে তো অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, তার উপর পড়াশোনা বেশিদূর করেননি। দুলাভাইয়ের সাথে আইনগত সম্পর্ক ছিন্ন করেননি যদিও কখনো, কিন্তু দুইটা বাচ্চাকে নিয়ে কখনো ভাইয়ের কাছে, কখনো বোনদের কাছে একপ্রকার ছিন্নমূল জীবন কাটাতে হয়েছে। কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করেছেন পর্যন্ত। অবশ্য ভাই বোনরা শেষ পর্যন্ত আপাকে দেখেছেন, পাশে থেকেছেন।

লিপি আপারও অতুলনীয় সৌন্দর্য ও মিষ্টি দুইটা বাচ্চা তার সংসার টেকাতে পারেনি, স্বামীকে ধরে রাখতে পারেনি। এমনকি সতীনকে মেনে নিয়েও তিলতিল করে গড়ে তোলা সংসারে থাকতে পারেননি তিনি। ১৭ বছর পর ফিরে যেতে হয়েছে। আপাও বাবা-মা, ভাইদের সমর্থন সহযোগিতা পেয়েছেন, পাশে পেয়েছেন। পড়াশোনা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ায় এবং পরিবারের সদস্যদের পাশে পাওয়ায় আত্মবিশ্বাসী আপা ভেঙে পড়েননি। একা বাসায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকতে পারছেন, পারিবারিক ব্যবসায় নিজেকে যুক্ত করায় সংসারের খরচ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। কিন্তু ইয়াসমিন আপার পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন ছিল। যদিও আপাও বাবা, ভাই-বোনদের সহযোগিতা পেয়েছেন, পাশে পেয়েছেন শেষ পর্যন্ত।

সংসারী রুনা দ্রুত বাস্তবতা মেনে নিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। সংসারে থাকাকালেও টুকটাক হাতের কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় এবং পড়াশোনা থাকায় দ্রুত নতুন জীবন, নতুন বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিয়ে চাকরিতে জয়েন করেছেন। মনের মতো কারো সাক্ষাৎ পেলে আবারও নতুন করে সংসার জীবনে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখবেন বলে মনে হয়েছে আলাপ করে। যদিও দুই ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে চিন্তিত। রুনাও পরিবার, মা-ভাই-বোনকে পাশে পেয়েছেন। কিন্তু যাদের বাবা-মা বেঁচে থাকেন না, ভাই-বোনরা পাশে থাকেন না, তাদের? তাদের কীরকম ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, হতে হবে, আমরা একবার ভেবে দেখেছি?

পড়াশোনা, চাকরি, বাবার বাড়ির সহযোগিতা না থাকা সহায়-সম্বলহীন একটা মেয়ের জন্য এইসব মোকাবেলা করা উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে সাঁতরে সাগর পারি দেওয়ার মতোই কঠিন। এইরকম অবস্থায় স্বামীর ঘরে অত্যাচারের মাত্রাও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। যাওয়ার জায়গা নেই, করে খাওয়ার উপায় নেই, কপর্দকহীন একটা মানুষ কতোটা অসহায় হয়ে যেতে পারে ভেবে দেখুন। এমনও দেখা গেছে, মেয়েটা শিক্ষিত ও বড় চাকুরে। কিন্তু বাবা-মা বেঁচে না থাকায়, ভাই -বোন নিজেদের মতো করে দূর দূরান্তে সংসারকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আরও বড় দাইন মারার সুযোগ পেয়ে স্বামী টাল্টি-বাল্টি শুরু করে। নানান পরিস্থিতি তৈরি করে সংসার ছেড়ে মেয়েটাকে চলে যাওয়ার। সেক্ষেত্রে মানসিক স্বনির্ভরতা ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা মেয়েটাকে অকূল পাথারে নিক্ষেপ করতে পারে না। মা-বাবা-ভাই-বোন, আত্মীয়-পরিজন ছাড়াও দিব্যি জীবনটাকে সচল রাখতে পারে, আবারও গুছিয়ে নিতে পারে সবকিছু নতুন করে।

এখানে যাদের কথা বললাম, এমন কতো কতো রুনা, লিপি, তাজরিন, শাহিনূর, ইয়াসমিনই আমাদের চারপাশে রয়েছেন। একটু চোখ কান খুলে, হৃদয় দিয়ে তাকালেই তাদের দেখতে পাবেন। কিছুটা স্বচ্ছল, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা মেয়েরা এইরকম পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন। তাদের না দেওয়া হয় পৈত্রিক সম্পত্তি, না দেওয়া হয় যেকোনো পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার মতো উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ ও সময়। না পারেন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পতিত হলে যেকোনো একটা কাজকে জীবীকার উপায় হিসেবে গ্রহণ করতে। তাই আপনার কন্যা, বোন, বন্ধুকে পড়াশোনা করে গড়ে ওঠার সময় ও সুযোগ দিন। এটা তাদের অধিকার। যেমন অধিকার আছে পৈত্রিক সম্পত্তিতে সমান ভাগ পাওয়ার এবং অধিকার প্রতিষ্ঠারও।

 

 

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাম্প্রতিকা