“নারীর সম-অধিকার, সম-সুযোগ
এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ।”
এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সারা দেশে যখন ২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবস মহাসমারোহের সাথে উদযাপিত হচ্ছিল, তা দেখে বারবার কেবল “গাছের গোড়া কেটে আগায় জল দেয়া” প্রবাদ প্রবচনটির কথা মনে পড়ছিল! যেমন মনে পড়ে, মেয়েদের মায়ের জাত- দেবি- দশভুজা- হোম মিনিস্টার- কল্যাণী- সাবিত্রী-সর্বংসহা ইত্যাদি ইত্যাদি অভিধায় অভিষিক্ত হতে দেখলে! নারীর প্রতি রাষ্ট্র- সরকার- পিতৃতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাস্তব জীবনে আইনী প্রাপ্য মেটানোর অনীহা দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এইসবের পিছনের আসল উদ্দেশ্য কী! প্রকৃতপক্ষে এসবই হলো, গাছকে মাটি থেকে মূলসহ উপড়ে ফেলে ফাঁকি দেওয়ার জন্য গাছের ডালে ও পাতায় জল দেয়া অর্থাৎ পরিচর্যা চালিয়ে যাওয়ার মতোই অনেকটা। যেন আমাদের থেকে বাস্তবতা ও প্রকৃত সত্য আড়াল করা যায়! সেজন্য ক্ষেত্রবিশেষে নারীর অসহায়ত্ব, ভীরুতা, আত্নবিশ্বাসের অভাব, পরনির্ভরতা, ঈর্ষাকাতরতা ও কর্তাসত্ত্বার অনুপস্থিতি দেখে এই দেবিদেরই আবার সমাজ ভিক্টিম ব্লেইমিং করতে ও “মেয়েমানুষ” বলে অভিহিত করতে একমুহূর্ত দেরি করে না! আমরা মেয়েরাও অধিকাংশই এইসব অভিধা শুনে আনন্দে বাক-বাকুম করে উঠি প্রায়শই এবং নিজেদের এসবই ভাবতে থাকি! ভাবতে থাকি আমরা তো ‘মেয়েমানুষ’। অথচ এসবের পিছনের রাজনীতি, মনস্তত্ব, অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য কম জনই ধরতে পারি, বুঝতে পারি।
বাংলাদেশের সংবিধানে নারী পুরুষের সমতার কথা বারবার ঘোষিত হয়েছে। স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে সমান মর্যাদা, অধিকার ও সুযোগের। শুধু তা-ই না, হাজার হাজার বছরের বঞ্চনার শিকার নারীদের সমাজের মূলধারায় যুক্ত করতে, ফিরিয়ে আনতে ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষ বিশেষ সুযোগের অধিকারের কথাও বলা হয়েছে। সংবিধানে নারীর অধিকার, সমতা ও সুযোগ সম্পর্কিত কয়েকটি ধারার কথা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় —–
২৭ অনুচ্ছেদ,,,, “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।”
অনুচ্ছেদ ২৮ (১),,,,কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।”
অনুচ্ছেদ ২৮ (২),,,”রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।”
অনুচ্ছেদ ২৮ (৪),,,নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।”
অনুচ্ছেদ ২৯ (১),,”প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।”
অনুচ্ছেদ ২৯ (২),,কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবে না, কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা হইবে না।”
অনুচ্ছেদ ৬৫ (৩) এ জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। সেজন্য নারীর জন্য ৫০টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ৫৯ অনুযায়ী স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়নে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।
সংবিধানের তৃতীয় ভাগের (মৌলিক অধিকার) ২৬ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।”
নারীর সমানাধিকা, বিশেষাধিকারের সাংবিধানিক আইনী স্বীকৃতি থাকলেও বাস্তব জীবনে আমরা কী দেখতে পাই? দেখতে পাই, এসবের বেশির ভাগই কাগুজে সান্ত্বনা মাত্র! মাইটোকন্ড্রিয়া যদি জীব কোষের শক্তির প্রাণকেন্দ্র বা আধার হয়ে থাকে, পিতার সম্পত্তিতে সন্তানের অধিকারের স্বীকৃতি, অধিকারের প্রতিষ্ঠা লাভ বাদবাকি অধিকার আদায় করে নেওয়ার শক্তির প্রধান উৎস, প্রধান শর্ত। ব্যক্তির অধিকারের এই মূল জায়গাটাতেই ধর্মের দোহাই দিয়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নারীদের পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার হওয়ার অধিকার থেকে সম্পূর্ণভাবে বাইরে রাখা হয়েছে। অপরদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের নারীদের পুত্র সন্তানের অর্ধেক অংশীদার করার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত করার বাস্তব, সামাজিক, পারিবারিক, মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।
পিতার সম্পত্তিতে যখনই কন্যা সন্তানকে পুত্র সন্তানের সম-অংশীদার করার অধিকার প্রসঙ্গে দাবি উত্থাপন করা হয়, তখনই ধর্মগুরু থেকে শুরু করে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সব শ্রেণি পেশার লোকই ধর্ম গেল, সমাজ গেল বলে শোরগোল তোলে। এক্ষেত্রে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ কোন সম্প্রদায়ই কেউ কারো চেয়ে কম যান না! তারা এমন সব যুক্তি দেখান, যেনবা ধর্ম-সমাজ- পরিবার-জগৎ- সংসারের যাবতীয় কিছুর টিকে থাকাই নির্ভর করছে কন্যা সন্তানকে পিতার সম্পত্তির অংশীদার হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার উপর।
হিন্দুপ্রথা ও বাংলাদেশের আইন অনুসারে পিতা-মাতা মারা গেলে পিতার সম্পত্তি শুধু ভাইয়েরাই পায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের কন্যা সন্তান পুত্র সন্তানের উপস্থিতিতে সম্পত্তির অধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়। পুত্র সন্তান না থাকলে অবিবাহিতা কন্যা এবং পুত্রবতী কন্যারা জীবনস্বত্বে সম্পত্তির অধিকার পায়। অন্যদিকে বন্ধ্যা, বিবাহিতা কন্যা, বিধবা কন্যা এবং কন্যা সন্তান জন্মদানকারী কন্যারা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। অর্থাৎ কন্যা সন্তানের অধিকার নির্ভর করে তার পুত্র থাকা বা না থাকার উপর। বৌদ্ধ ধর্মের উৎস হিন্দু ধর্ম হওয়ায় এবং বৌদ্ধ ধর্মে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে কোন আলাপ না থাকায়, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মের উত্তরাধিকার আইন অনুসরণ করা হয়।
বিভিন্ন সংস্থার গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য দ্বারা তৈরি আইন কমিশন প্রদত্ত “হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কারের সুপারিশ বিষয়ক আইন কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন” বা “খসড়া হিন্দু উত্তরাধিকার আইন-২০২০”
থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার প্রাপ্তির বিরুদ্ধ পক্ষের যুক্তিগুলো হলো,,
*** নানা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে মেয়েরা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তাদের সম্পত্তির অংশ রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে না এবং সামান্য মূল্যের বিনিময়ে তা প্রভাবশালী বিত্তবান লোকের হাতে চলে যাবে!
*** সম্পত্তির লোভে অন্য ধর্মের লোক হিন্দু নারীদের প্রলোভিত করে তাদেরকে সম্প্রদায় ত্যাগ করতে বাধ্য করবে, যার ফলে হিন্দু সমাজ ও সম্পত্তি ধ্বংসের মুখোমুখি হবে!
মুসলিম কন্যা সন্তানকে পুত্র সন্তানের অর্ধেক অংশীদার করার পিছনে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যেসব যুক্তি দেখিয়ে থাকে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো, নারীদের অন্য অনেক দিক থেকে সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হয়েছে। “তারা তো স্বামীর সম্পত্তির ভাগ পায়!” “তাদের তো দেনমোহর দেয়া হয়”। কাজেই তাদের পিতার নিকট থেকে এতো সম্পত্তির দরকার নেই! প্রকারান্তরে তারা যেন বলতে চান, মেয়েদের এত্তো এত্তো দিক থেকে সম্পত্তির অংশীদার করা হয়েছে, তারপরও পিতার সম্পত্তির কী দরকার! ভাবটা এমনই, যেন অন্যান্য দিক থেকে সম্পত্তির অংশীদার হওয়ার অধিকার শুধু মেয়েদেরই করা হয়েছে, ছেলেদের করা হয়নি! স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তান থাকলে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির ২ আনা, সন্তান না থাকলে ৪ আনা অংশীদার হোন। অপরদিকে স্ত্রীর মৃত্যুর পর সন্তান থাকলে স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তির ৪ আনা, সন্তান না থাকলে ৮ আনা সম্পত্তির অংশীদার হোন। অর্থাৎ স্বামী বা স্ত্রী যে কারো মৃত্যু হলে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির যতোটুকু ভাগের অধিকারী হোন, স্বামী হোন স্ত্রীর তুলনায় দ্বিগুণ সম্পত্তির অধিকারী। অথচ প্রায়ই যুক্তি হিসেবে নিয়ে আসা হয়, মেয়েরা তো স্বামীর সম্পত্তির ভাগ পায়!
আর উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েদের ছাড়া অন্য মেয়েদের ক্ষেত্রে দেনমোহর খুব সামান্যই নির্ধারিত হয়। আর সব ক্ষেত্রেই যা-ও নির্ধারণ করা হয়, সেটাও কদাচিৎ পরিশোধ করা হয়। অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত অধিকারগুলোর মতো শূন্য বা বকেয়াই থেকে যায় আজীবন! তাছাড়া দেনমোহরের মাধ্যমে অর্থ কিংবা সম্পত্তি প্রাপ্তির অধিকারকে কখনোই সম্মানজনক বলে মনে করা যায় না। এক্ষেত্রে দেনমোহর দিয়ে স্বামীরা সাধারণত মনে করে, স্ত্রীকে অর্থের মাধ্যমে কিনে এনেছে! এজন্য অনেক শিক্ষিত, আধুনিক মেয়েই দেনমোহর ছাড়া অর্থাৎ নামমাত্র প্রতীকী দেনমোহরে বিয়ে করেন আজকাল।
বাস্তব জীবনে আমরা কী দেখি? আমরা দেখতে পাই, পৈত্রিক সম্পত্তি ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে সম্পত্তি প্রাপ্তির সুযোগ ঘটে দৈবাৎ। কেননা পৈত্রিক সম্পত্তি আগের প্রজন্ম থেকে কোন রকম মাধ্যম ছাড়া সরাসরি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়। এই প্রাপ্তির সুযোগ ১০০ ভাগ নিশ্চিত। অপরদিকে অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তির অধিকারের উৎস নিজেরই প্রজন্ম কিংবা পরের প্রজন্ম, যা প্রাপ্তির সুযোগ প্রায় ১০০ ভাগই অনিশ্চিত! সেটা নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যেমন: ভাই- বোন-পুত্র-কন্যার নিকট থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তির দাবিদার তখনই হওয়া যায়, ক্ষেত্রবিশেষে শেষ জীবনে তারা গত হলে এবং নিঃসন্তান হলে। তাছাড়া সম্পত্তি সন্তানদের, বিশেষ করে পুত্র সন্তানদের দখলে থাকে বিধায় সেখান থেকে কোন অংশীদারের প্রাপ্য সম্পদ বের করে নিয়ে আসা আর এভারেস্ট জয় করা একই বিষয়। এভারেস্ট চূড়া জয় করে অক্ষত দেহে ফিরে আসা যেমন অতিশয় দক্ষতা ও ভাগ্যের ব্যাপার, তেমনি ভাই কিংবা তাদের সন্তানদের নিকট থেকে নিজের সম্পত্তির অংশ বের করে নিয়ে এসে সুস্থ ও স্বাভাবিক পারিবারিক, সামাজিক, আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে পারা অমাবস্যার চাঁদ দেখতে পাওয়ার মতোই অসম্ভব ঘটনা! এই প্রায় ১০০ ভাগ অনিশ্চিত ক্ষেত্র থেকে সম্পত্তি প্রাপ্তির মূলো দেখিয়ে, মেয়েদের ১০০ ভাগ নিশ্চিত ক্ষেত্র থেকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়েরা যখনই পিতার সম্পত্তির অধিকার চাইতে যায় তখন এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চোখে তারা হয়ে যায় অবলা, সরলা, নির্বোধ, ছেলে ভুলানো প্রলোভনে আকৃষ্টা। আর নির্ধারিত পৈত্রিক সম্পত্তি অর্থাৎ নিজের সম্পত্তির ভাগ আনতে গেলে মুসলিম মেয়েদের লোভী, ছোট লোক, আত্মসম্মানবোধহীন ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করা হয়! বলা হয়, ভাইয়ের কাছ থেকে সম্পত্তির ভাগ আনতে চাচ্ছে! ভাইয়ের সম্পত্তি আবার কী! ভাই কি নিজের সম্পত্তির ভাগ দেয় নাকি! নিলে ভাইয়ের কাছে রেখে যাওয়া বোন তার নিজের সম্পত্তি নিবে! উল্টো ভাই যে বোনের সম্পত্তি ভোগ দখল করে খাচ্ছে, সেটা যেন কিছু না! আমরা যখনই নিজেদের অধিকার-স্বাধীনতা-কর্তাসত্ত্বা নিয়ে ভয়েস রেইজ করি, হিস্যা দাবি করি, এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কাছে তখন আমরা অবলা, সরলা, নির্বোধ, ছেলেভোলানো গল্পে আকৃষ্টা, লোভী, ছোট লোক, রাতের রাণী, ভ্রষ্টা, নষ্টা, ডাইনী, নারীবাদী, ধর্মবিরোধী, নাস্তিক ইত্যাদি ইত্যাদি হয়ে যাই। আর পুরুষ তখন তাদের কাছে উল্টো হয়ে যায়, দায়িত্বশীলতার পরাকাষ্ঠা-মহান-অতি সরল- নির্বোধ-ছেলে ভুলানো গল্পে আকৃষ্ট অতি ভালো- পূত- পবিত্র।
মুসলিম পারিবারিক আইনে পিতার সম্পত্তিতে কন্যা সন্তানের অংশীদারিত্ব পুত্র সন্তানের অর্ধেক হওয়ার কথা থাকলেও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পুরোটাই কাগুজে বাঘের মতোই। পিতার সম্পত্তির ভাগ চাইতে গেলেই পিতৃতন্ত্রের প্রতিনিধিরা চারদিক থেকে বলা শুরু করে এবং দৃষ্টান্ত খুঁজে নিয়ে আসে সম্পত্তির ভাগ নিলে নাকি ভাইদের অভিশাপ সারা জীবন বহন করতে হবে বোনদের। আর ভাইয়েরাও মনে করে, বোনেরা সম্পত্তির ভাগ নিয়ে গেলে ভাই-বোনের সম্পর্ক চর্চার প্রয়োজনীয়তাও চুকিয়ে যায় এবং চুকিয়ে ফেলার হুমকিও দেয়া হয়। শুধু তা-ই না, চুকিয়ে ফেলাও হয়, যারা সবকিছু অগ্রাহ্য করে পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগ চাইতে আসে। একদিকে ‘ভাইদের অভিশাপের মিথ’, সমাজ ও আত্মীয়-পরিজনদের কাছে ‘লোভী’ ও ‘ছোটলোক’ বনে যাওয়া, বাপের বাড়ির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ইত্যাদি মেয়েদের মধ্যে যে আতংক আর ডিল্যেমার জন্ম দেয়, সারাজীবন তারা সেটা থেকে বের হতে পারে না সাধারণত। আর মেয়েদের বের হওয়ার মতো করে কর্তাসত্ত্বার বিকাশের সুযোগ, সময়, পরিবেশ, শিক্ষাও দেওয়া হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। পৈত্রিক সম্পত্তি ভাগাভাগির পর যদি ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের সম্পর্ক শেষ হয়ে না যায়, তাহলে ভাইয়ের সাথে বোনের সম্পর্ক সমাপ্তির এই আতংক মেয়েদের মনে সচেতনভাবে ঢুকিয়ে দেওয়ার এবং সম্পর্কচ্ছেদের পিছনে গূঢ় উদ্দেশ্য ও স্বার্থ রয়েছে। সেটা হলো, সচেতনভাবে বোনদের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জমিন তৈরি রাখা। এর ফলে মুসলিম নারী কদাচিৎ বাবার সম্পত্তির ভাগ চাইতে যায়, চাওয়ার সাহস দেখা যায়।
একটা সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিক পারিবারিক পরিবেশে বেড়া ওঠা মেয়েও যখন শৈশবেই চারপাশের নানা ঘটনা ও পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে জেনে যায় এবং বুঝতে পারে, সে তার ভাইয়ের সমান না। সেটা সম্পত্তির অধিকারের দিক দিয়েও না, আবার জীবন যাপনের দিক দিয়েও না। এই বাস্তবতা মেয়েদের মনস্তত্ব গঠনে বিরাট প্রভাব ফেলে। ফলে শৈশব থেকেই মেয়েরা একপ্রকার অস্তিত্বহীনতার সংকটে ভোগে। এই অস্তিত্বহীনতার সংকট যেটুকু প্রাপ্য অধিকার, সেটুকুও চেয়ে নেওয়ার সাহস নিঃশেষ করে দেয়। বড় কিছুর স্বপ্ন দেখার জন্যও পায়ের তলায় মাটি থাকা লাগে। তাই তাদের জীবনে বড় কোন লক্ষ্য, উদ্দেশ্য কমই থাকে। কোন রকম টিকে থাকাই তাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে তাদের চিন্তাও থাকে মূলত বিয়েকেন্দ্রিক, স্বামীকেন্দ্রিক। এমনকি একটা মেয়ে লেখাপড়া শেষ করে ভালো কোন পেশায় গিয়েও সৎভাবে উপার্জন করে জায়গা কিনে, ছোট্ট একটা বাড়ি করতে জীবনের ৪/৫ সময় চলে যায়। অপরদিকে তারই কোন ভাইকে দেখা যাবে, কষ্ট করে পড়াশোনা করে চাকরি কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য ছাড়াই জন্মের পর পরই এরচেয়ে কয়েক গুণ বেশি সম্পদের অধিকারী হয়ে গিয়েছে শুধু ছেলে বলে। দেশের ৯৬% জমির মালিক পুরুষ, এই নির্মম সত্যটাই আমাদের সামনে নিয়ে আসে। এই একুশ শতকেও এই বৈষম্য চূড়ান্ত মাত্রায় অন্যায়, গর্হিত অপরাধ।
সম্পত্তিতে সমান উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবির মধ্যে কেবল নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নই জড়িত না, নারীকে একজন পূর্নাঙ্গ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টা জড়িয়ে রয়েছে। অর্ধেক কিংবা পুরোপুরি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে নারীকে ঊনমানুষ ও নয় মানুষ বানিয়ে রাখা হয়েছে। যারা নয় মানুষ, পূর্নাঙ্গ/ সম্পূর্ণ মানুষ না, তাদের শুধু অর্ধেক না, সবটা থেকেই বঞ্চিত করা যায়। তাদের সাথে যা খুশি তা-ই করা যায়। এই ন্যায্যতা তৈরি হয়ে যায়। এবং শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে এই ন্যায্যতা তৈরি হয়ে এসেছে। স্বামীর মৃত্যুর পর তার চিতায় তারই কয়েক শত সুস্থ, সবল, জীবিত স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে দুই দু’শো বছর আগেও। শুধুমাত্র সন্তান কিংবা পুত্র সন্তান জন্ম দিতে না পারায় আজও স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হয়, কিংবা বিয়ে করে নতুন স্ত্রী ঘরে নিয়ে আসা হয়।
বাংলাদেশের মেয়েদের বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাদের এই আশ্রয়হীনতা, সম্পত্তিহীনতার সুযোগ ভালোভাবেই নেয় । তারা জানে যতোই অপমান- অসম্মান- শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা হউক না কেন, কর্মহীন ও উপার্জনহীন গৃহবধূটির এইসব নির্যাতন সহ্য করে শ্বশুর বাড়িতে থেকে যাওয়া ছাড়া আর কোন দ্বিতীয় অপশন খোলা নেই। বাবা ভাইও পাত্রস্থ করার মধ্য দিয়ে যে দায়িত্ব শেষ করে দিয়েছিলেন, পুনরায় সে দায়িত্ব কাঁধে নিতে চান না। বাড়তি বোঝা বলে মনে করেন। বাপের বাড়িতে ফিরে গেলেও সেখানে তাদের জন্য অধিকারহীন আরেক পরজীবীর জীবন অপেক্ষা করে থাকে।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের বাত, আথ্রাইটিস, স্পোর্টস ইনজুরি ও পক্ষাঘাত রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা: মনিরুল ইসলাম মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার নিয়ে আলাপকালে কথা প্রসঙ্গে জানান, নারীদের নিজেদের কাছে অর্থ সম্পদ না থাকায়, অনেক সামর্থ্যবান স্বামীও স্ত্রীর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার খরচ বহন করতে চান না। নানান অজুহাতে মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দেন।
অথচ মেয়েরা যদি ভাইদের মতো পিতার সম্পত্তির ভাগ পেতো, তাহলে শ্বশুর বাড়িতে তাদের কদর থাকতো। আর কোন কারণে নির্যাতনের শিকার হলে, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলেও নতুনভাবে জীবন শুরু করার এবং জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার রসদের অভাবে পড়তে হতো না। অসহায়ের মতো শ্বশুর বাড়ির নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করা, আত্মহত্যাকে বেছে নেওয়া কিংবা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে দুই দিন পর পর পত্রিকার শিরোনাম হতে হতো না আমাদের বোনদের! একদিকে পড়াশোনার মাধ্যমে বোধ বুদ্ধি তৈরি ও সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির সময় সুযোগ না দিয়ে বিয়ে দিয়ে এবং অপরদিকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে নারীদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাতারে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
অনেকে বলতে পারেন এবং বলেনও, ‘আইন দিয়ে কী হবে?’ বর্তমান জমানায় আইনগত ভিত্তি অবশ্যই অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রধান ভিত্তি এবং প্রথম শর্ত। আইনগত ভিত্তি না থাকলে অধিকার প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, দাবিই তো তোলা যায় না। পৈত্রিক সম্পত্তিতে কন্যা সন্তানের সম-অংশীদারিত্ব না থাকায়, যেসব পরিবারে কেবল কন্যা সন্তান থাকে অর্থাৎ কোন পুত্র সন্তান থাকে না, সেরকম প্রায় প্রতিটি পরিবারে এক অনন্ত যুদ্ধ চালু হয়ে যায় চাচাতো ভাইদের সাথে সম্পত্তি নিয়ে এই আইনগত কারণেই। এক্ষেত্রে চাচা অর্থাৎ চাচাতো ভাইদের আইনগতভাবে সম্পত্তির অংশীদার করায় তারা চায় চাচাতো বোনের সম্পত্তি দখল করে নিতে। অপরদিকে কন্যা সন্তানের পিতা-মাতারা চান, সমস্ত সম্পত্তি নিজের কন্যা সন্তানকে দিয়ে যেতে। পৈত্রিক সম্পত্তিতে কন্যা সন্তানের সম-অংশীদারিত্ব এই পারিবারিক জটিলতার নিরসন করতে পারে। এই আইনগত ভিত্তির কারণেই অসহায়, বন্ধ্যা, নির্যাতিতা, বিধবা হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নারীদের বিয়ের পর ভাইয়ের বাড়িতে স্থান পাবে কিনা সেটা একান্তই ভাই-ভাবির দয়া ও করুণার উপর নির্ভর করে। আর স্থান পেলেও সেটাকে কোন সম্মানজনক স্থান পাওয়া বলে না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। অনেকটা বাড়ির চাকরানীর মতো স্থান পাওয়া।
পৈত্রিক সম্পত্তিতে সমান অংশীদারিত্ব শৈশবেই কন্যা শিশুর ভাবজগতকে আমূল বদলে দিবে। তাদের স্বপ্ন, লক্ষ্য, আকাঙ্ক্ষা, জীবনবোধকেও প্রভাবিত করবে। আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিবে। পরজীবি না হয়ে সংগ্রামী জীবন বেছে নিতে উজ্জীবিত করবে। ‘এতো কিছু করে অর্ধেক সম্পত্তি এনে আর কী হবে’, ‘এই অর্ধেকও তো দেয়া হবে না, সামান্য কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে সমস্ত সম্পত্তি লিখিয়ে নেয়া হবে’, এখন এমন মনোভাব কাজ করে সাধারণত। সমান সমান হলে কিন্তু এমনটা কাজ করবে না। আগের মতো সম্পত্তি না দেওয়ার জন্য সকল ফন্দি ফিকির ব্যর্থ হয়ে যাবে। জন্মের পর কোন মানুষ যখন ভাবতে শিখে সে কারো থেকেই ছোট না, তখন তাকে দমিয়ে রাখা পৃথিবীর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। সম্পত্তির সম-অংশীদারিত্ব কন্যাদের মনে এই বোধটাই জাগিয়ে তুলতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। শুধু সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা না, অন্য সকল অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও এই বোধ কাজ করবে। এটা নারীদের জীবনবোধ থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে তাদের ব্যাপ্তি, উজ্জ্বলতা আমূল বদলে দিবে। তাদের এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে ভূমিকা পালন করবে।
একটা দেশের প্রায় অর্ধেক নাগরিককে কখনো আইনগতভাবে, কখনো প্রায়োগিকভাবে জীবন- স্বাধীনতা- সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং কর্তাসত্ত্বা গড়ে ওঠার পথে অনতিক্রম্য প্রতিবন্ধকতা রেখে তাদের প্রকৃত বিকাশ যেমন সম্ভব নয়, তেমনি দেশটাকে একটা নূন্যতম পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবেও গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এই কথা কি প্রায় ৩৫ বছর যাবৎ প্রধান নির্বাহী ক্ষমতায় থাকা নারী প্রধানমন্ত্রীরা তথা দেশের প্রধান নীতি নির্ধারকরা জানেন না? অবশ্যই জানেন। না জানার কথা নয়। এরপরও তারা গন্তব্যে পৌঁছাতে অতি সংক্ষিপ্ত এবং প্রধান রাস্তা বাদ দিয়ে বছরের পর বছর দূরের অলিতে গলিতে ঘুরপাক খাচ্ছেন এবং আমাদেরও খাওয়াচ্ছেন। এবং গাছের গোড়া কেটে দিয়ে আগায় জল দিয়ে চলেছেন!
দার্শনিক জন লক (১৬৩২-১৭০৪) সেই ১৭ শতকেই অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় চারশত বছর আগে জানান দিয়ে গিয়েছেন… মানুষের ৩ টি প্রাকৃতিক তথা জন্মগত অধিকারের কথা : জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তি (Life, Liberty and Property) এবং নাগরিকদের এইসব জন্মগতভাবে পাওয়া অধিকারের সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্র যে নৈতিকভাবে বাধ্য সে কথা। নিজেদের সভ্য বলে দাবি করা পুঁজিবাদী দেশগুলোও বহু আগেই তাদের নাগরিকদের জন্মগতভাবে পাওয়া এসব অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে এবং বাস্তব জীবনে কার্যকর করেছে।
এই লক্ষ্যেই জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে সার্বজনীন মানবাধিকার আইন ঘোষণা করেছে। ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ বা Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women বা সংক্ষেপে সিডও (CEDAW) সনদ গৃহীত হয়। নারীর জন্য আন্তর্জাতিক বিল অফ রাইটস বলে চিহ্নিত এ দলিল নারী অধিকার সংরক্ষণের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মানদণ্ড বলে বিবেচিত হয় পুঁজিবাদী দুনিয়ায়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে সিডও সনদে স্বাক্ষর করে। কিন্তু সিডও সনদে বাংলাদেশ অনুমোদন করলেও তা পরিপূর্ণভাবে করেনি। বাংলাদেশ সরকার শুরুতে সিডও সনদের ধারা-২, ১৩(ক), ১৬.১(গ) ও (চ) ধারাগুলোয় আপত্তি জানিয়ে তা অনুমোদন করেনি। পরবর্তী সময়ে সরকার ১৩(ক), ১৬.১(চ) অনুচ্ছেদ থেকে আপত্তি তুলে নেয়। বাকি ২টি ধারা থেকে আপত্তি তুলে নেয়নি এবং অনুমোদন করেনি আজও ।
বাংলাদেশ সরকারের আপত্তি দেয়া ২টি ধারার মধ্যে
ধারা-২তে, বৈষম্য বিলোপ করে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা স্থাপনের জন্য নীতিমালা গ্রহণের অঙ্গীকার করা হয়েছে। প্রতিটি দেশের জাতীয় সংবিধান, আইন-কানুন ও নীতিমালায় নারী ও পুরুষের সমতার নীতিমালা সংযুক্তকরণ ও তার প্রয়োগ নিশ্চিতকরণের অঙ্গীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইন-কানুন, রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার নিষিদ্ধ করার কথা। সব ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা। এজন্য আদালত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারীকে সব ধরনের বৈষম্য থেকে রক্ষা করা এবং ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নারীর প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন রোধ করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে।
ধারা-১৬.১(গ): বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদকালে নারী ও পুরুষের একই অধিকার ও দায়দায়িত্ব নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। সরকার বর্তমানে প্রচলিত আইনগুলোর পর্যালোচনা করবে এবং একটি সর্বজনীন পারিবারিক আইন চালু করবে, যা সব ধর্ম ও বিশ্বাসের লোকদের ক্ষেত্রে একইভাবে প্রযোজ্য হবে। এতে বিয়ে এবং তালাকের সময় সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করবে। সরকার নারী উন্নয়ন নীতিমালা-১১, জাতীয় বাজেট ইত্যাদিতে নারীদের জন্য হ্যান করেঙ্গে, ত্যান করেঙ্গে বলে কথামালার পর কথামালা গেঁথে গিয়েছে। কিন্তু সিডও সনদের ধারা-২ ও ধারা১৬.১(গ) এই দুটি ধারার মধ্যে যে নারী উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রাণভোমরা লুকিয়ে রয়েছে, সেখানে এসে কবি নিরব!
এই দুটি ধারা অনুমোদন ও কার্যকর করা না হলে আগামী ৫ শত বছরেও পুঁজিবাদী দুনিয়ায় নারী উন্নয়ন ও নারী পুরুষ সমতার যে মানদণ্ড রয়েছে, তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। শুধু তা-ই না, এ ২টি ধারা কার্যকর না করে নারীকে পুরুষের সাথে সমান তালে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাগিদ দেওয়া আর হাত-পা বেঁধে উত্তাল নদী পারি দেওয়ার জন্য বলা একই কথা। এটা শুধু নারীর সাথে মস্করা না, চূড়ান্ত মাত্রায় প্রতারণাও।
১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক এই স্বাধীন, সার্বভৌম, গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ঘটানো হয়েছিল সকল প্রকার অসমতা, অন্যায্যতা, বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে’(স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র)। সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদেও সমতার অঙ্গীকার করা হয়েছে ( ২৭ অনুচ্ছেদ)। এবং রাষ্ট্রের কোন আইন সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলে, যেটুকু অসামঞ্জস্যপূর্ণ সেটুকু বাতিল বলে গণ্য করার অঙ্গীকার করা হয়েছে ( ২৬ এর দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ)।
রুশোর মতে, আমাদের প্রত্যেকটি স্বাধীন কার্যই ২টি শক্তির সম্মিলনে সম্পাদিত হয়।
১/ নৈতিক /নীতিগত /ইচ্ছা/ ইচ্ছাশক্তি,
২/ দৈহিকশক্তি,
দৈহিকশক্তি নীতিগত বা ইচ্ছাশক্তিকে কার্যে পরিনত করে। তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যখন কেউ হাঁটতে শুরু করে তাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হয়, সিদ্ধান্ত নিতে হয় কোন স্থানে বা লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছাতে চায়। বস্তু/ স্থানটির কাছে যাওয়ার দ্বিতীয় শর্ত হলো, কাঙ্খিত লক্ষ্যে বা স্থানে পৌঁছে দেওয়ার মতো শক্তি দুটি পায়ের আছে কিনা? একজন পঙ্গু ব্যাক্তির মানসিক ইচ্ছে হতে পারে দৌঁড়ে যাওয়ার। আবার একজন সুস্থ মানুষের দৌঁড়াবার ইচ্ছে নাও থাকতে পারে। বাস্তবে দুজনার ক্ষেত্রেই ফল একটিই। তারা উভয়েই একই স্থানে অবস্থান করবে। তাদের কারুরই অবস্থানগত কোন পরিবর্তন ঘটবে না।
রাষ্ট্রসংস্থার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তাই। একটি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের ও তাদের মানসকে কীভাবে গড়ে তুলতে চায়, তাদের দৃষ্টিভঙ্গী কেমন দেখতে চায়, সে সম্পর্কে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সিদ্ধান্ত নিতে হয় নাগরিক তার সহনাগরিকের সাথে কেমন আচরণ প্রদর্শন করবে এবং সেইভাবে তাদের গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নিতে হয়। নারীর অবস্থা, অবস্থান, পড়াশোনা, অধিকার, পোশাকের স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, নারী পুরুষ সম্পর্কে নারীর অবস্থান কেমন হবে সে সম্পর্কেও আগে প্রতিটি রাষ্ট্রকে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেজন্য নীতি নির্ধারণ করে কর্মসূচি ও প্রকল্প হাতে নিতে হয়। পরবর্তীতে রাষ্ট্রের রিপ্রেসিভ ( পুলিশ, আদালত, সেনাবাহিনী ইত্যাদি) ও আইডিওলজিক্যাল ( আইন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, সিনেমা, নাটক, সংস্কৃতি ইত্যাদি) স্টেট অ্যাপারেটাসগুলোকে সেসব নীতি, কর্মসূচি, প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগানো হয়। অর্থাৎ নারীর উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য প্রথম বিনিয়োগটা রাষ্ট্রকেই করতে হবে।
১৯৬১ সালে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন থেকে না-শরীকের ধারা বাতিল করায় কতো শতো এতিম সন্তানের দীর্ঘশ্বাস যে রোধ করা গিয়েছে, আমাদের আশেপাশে একটু দৃষ্টি দিলেই দেখতে পাবো। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সে তার দ্বিমুখী ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এসে নারীর পক্ষে তথা নারীকে এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিবে কিনা এবং সে অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন করে কর্মসূচি নিবে কিনা ? না নারীবিরোধী, পিতৃতান্ত্রিকদের পক্ষেই তার অবস্থান জারি রাখবে?
যদি নারীবিরোধীদের পক্ষেই রাষ্ট্র তার অবস্থান জারি রাখে, তাহলে দেশের নারী সমাজকেও ভেবে দেখতে হবে, এই দ্বিচারী ও পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে তাদের সম্মতি অবিরত দিয়ে যাবে কিনা?