ভালেরি সোলানাসের SCUM Manifesto যখন পড়তে বসি, তখন বারবার একটা প্রশ্নই আমাদের মাথায় ঘোরে। এই রচনাটিকে আমরা কীভাবে পাঠ করবো? এই ম্যানিফেস্টো কি আক্ষরিক অর্থেই কোনো ম্যানিফেস্টো? নাকি এটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তীব্র সমালোচনা করে লেখা কোনো ব্যঙ্গরচনা? সোলানাসের প্রস্তাবনাগুলোকে আমরা কি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করবো? নাকি সেগুলোর কোনো গভীর প্রতীকী ব্যঞ্জনা রয়েছে? আমরা যদি খুব মনোযোগ দিয়ে ম্যানিফেস্টোটি পাঠ করি এবং সোলানাসের অন্যান্য রচনাকে পাশাপাশি রেখে বিষয়টি বিবেচনা করি, তো দেখতে পাবো যে, সোলানাসের রচনাকে কোনো একমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার সুযোগ আমাদের হাতে নেই। তাছাড়া একটা ম্যানিফেস্টোকে কেবল তার প্রস্তাবনাগুলোর ভিত্তিতে বিচার করা অনুচিত। যে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে একটি ম্যানিফেস্টো রচিত হয়, সেই পরিপ্রেক্ষিতটি বোঝাই বরং বেশি জরুরী। একবার সেই পরিপ্রেক্ষিতটি বুঝে নিতে পারলে আমরা এ-ও বুঝতে পারবো যে, সোলানাস যতোটা প্রতীকী, ততোটাই আক্ষরিক। তাঁকে বোঝার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ধারণা রাখা জরুরী। কিন্তু ব্যক্তি সোলানাসকে যদি দূরে সরিয়েও রাখি, তবু তাঁর রচনার প্রাসঙ্গিকতা কিছু কমে যায় না।
SCUM Manifesto সচরাচর একটি উগ্র নারীবাদী রচনা হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে। কিন্তু যে প্রশ্নটি না করলেই নয়, সেটি হচ্ছে, সোলানাস কি নারীবাদী ছিলেন? তিনি নিজে কিন্তু কখনো এমন কোনো দাবি করেননি। বরং তাঁর যুগের সামাজিক ও জ্ঞানায়তনিক পরিমণ্ডলে সক্রিয় নারীবাদীদের থেকে তিনি আজীবন দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন। কিন্তু এরপরও মানসিকভাবে অসুস্থ একজন উগ্র নারীবাদী হিসেবেই বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত হতে হয়েছে তাঁকে। এবং তাঁর চিন্তার বৃহত্তর রাজনৈতিক ও দার্শনিক আবেদন খুব কম বিশ্লেষকই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এর কিছু কারণও আছে অবশ্য। প্রথমত, সোলানাসের ভাষা। যে উগ্র, ‘অশ্লীল’ ও আক্রমণাত্মক ভাষায় সোলানাস পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণ করেছেন সবসময়, জ্ঞানায়তনিক পর্যায়ে সেই ভাষার গ্রহণযোগ্যতা কম। SCUM Manifesto তো বটেই, তাঁর ব্যঙ্গ-নাটিকা ‘Up Your Ass’, কিংবা তাঁর ক্ষুদ্র রচনা ‘A Young Girl’s Primer on How to Attain the Leisure Class’- এই সবই খিস্তিখেউড়ে ভরপুর। এই বিশেষ রচনারীতি সোলানাসকে তাঁর যাবতীয় রাগ, ক্ষোভ, আক্রোশকে উগরে দিতে সাহায্য করেছে এবং তাঁর সমালোচনাকেও দিয়েছে এক আশ্চর্য স্বচ্ছতা ও তীব্রতা। সমস্যাটা হচ্ছে, অধিকাংশ পাঠকই এই রচনারীতির সামনে দাঁড়িয়ে বিপর্যস্ত বোধ করেন এবং খিস্তিখেউড়ের বহর দেখে সোলানাসকে তারা আর কোনো সুস্থ, চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে ভাবতে পারেন না এবং ভাবতে চানও না। সোলানাসের উগ্রতা ও পুরুষবিদ্বেষই তখন তাদের চোখে পড়তে থাকে এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের চোখ এড়িয়ে যায় এমন অনেক মন্তব্য, যেখানে সোলানাসের রাজনৈতিক ও দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি অত্যন্ত সাবলীলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, তিনি যখন লেখেন, ‘What will liberate women, therefore, from male control is the total elimination of the money-work system, not the attainment of economic equality with men within it.’
কিংবা যখন লেখেন, “The purpose of `higher’ education is not to educate but to exclude as many as possible from the various professions.”
কিংবা, ‘Our society is not a community, but merely a collection of isolated family units.”
তখন তাকে নেহাত ‘উগ্র নারীবাদী’ বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না আমাদের পক্ষে। আধুনিক, নগরভিত্তিক, পুঁজিবাদী সভ্যতার এক তীক্ষ্ণ সমালোচনা তিনি হাজির করেন আমাদের সামনে। এখানে একটা জিনিস আমাদের চোখে পরিষ্কার হয়ে যায়, সেটা হলো, বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার মধ্যে থেকেই নারী-পুরুষের সাম্য নিশ্চিত করাই যদি নারীবাদের কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য হয়, তো সোলানাস নারীবাদী নন কোনো অর্থেই। কিন্তু নৈরাজ্যবাদী তিনি অবশ্যই। কারণ যে মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (রাষ্ট্র, পরিবার, প্রজনন, টাকা, শ্রম, ইত্যাদি) ওপর এই পুঁজিবাদী ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকেই তিনি আমূল গুঁড়িয়ে দিতে চান।
এখন প্রশ্ন হলো, সোলানাস সাম্যে বিশ্বাসী নন কেনো? তাঁর পুরুষ-বিদ্বেষ এবং নারীর শ্রেষ্ঠত্বে গভীর বিশ্বাসের কারণ কী? সোলানাস কি আসলেই পুরুষ-জাতির শারীরিক বিলোপ কামনা করতেন? সোলানাসের জীবনের অন্তত একটি ঘটনা আমাদেরকে এমনটাই বিশ্বাস করতে প্ররোচিত করে। অ্যান্ডি ওয়ালহোলকে গুলি করে হত্যা করতে চেয়েছিলেন সোলানাস। যদিও শেষ পর্যন্ত সে কাজে সফল হননি এবং সফল না হওয়ার জন্য পরে আফসোসও করেছেন। কিন্তু যদি আমরা ধরেও নিই যে, সোলানাস এক বিরাট গণহত্যার মাধ্যমে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পৃথিবীর তাবৎ পুরুষজাতিকে বিলুপ্ত করে দিয়ে পৃথিবীকে কলঙ্কমুক্ত করতে চেয়েছিলেন, তবু, আগেই যেমন বলা হয়েছে, আমাদের উচিত সেই পরিপ্রেক্ষিতটি বিবেচনা করে দেখা, যেটা সোলানাসকে এই প্রস্তাবনা দেওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। কিংবা বলা ভালো, তাঁকে বাধ্য করেছে। আমরা সে প্রসঙ্গে আসবো, তবে তার আগে সোলানাসের পুরুষ-বিদ্বেষ সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার।
পুরুষজাতিকে সোলানাস পৃথিবীর সকল সমস্যার মূল কারণ মনে করতেন। এই কথাটা অবশ্য তিনি ঢালাওভাবেই বলেছেন, তবে অকারণে বলেননি। সোলানাসের নিকট প্রতিটি পুরুষই এক অসম্পূর্ণ মানুষ। পুরুষ হলো অহংসর্বস্ব, অস্থির ও আত্মকেন্দ্রিক। পুরুষ ভালোবাসতে পারে না। তাদের কোনো স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা নেই এবং কোনো গভীর অনুভূতি ধারণ করতেও অক্ষম। পুরুষ ভীরু, অসৃষ্টিশীল এবং সর্বোপরি পুরুষ হলো কামুক। নারীসঙ্গ ছাড়া পুরুষ বাঁচতে পারে না। যদিও এই ব্যাপারটা স্বীকার করতে তাদের অহংকারে বাঁধে। পক্ষান্তরে বিশুদ্ধ নারীত্ব হলো সমস্ত ইতিবাচক গুণের এক সমাহার। সোলানাসের মতে একজন প্রকৃত নারী হলো স্বাধীন, সাহসী, সৃষ্টিশীল, মেধাবী, আত্মবিশ্বাসী, প্রাণবন্ত, গভীর আবেগ ও অনুভূতিসম্পন্ন, সহানুভূতিশীল এবং অতি অবশ্য কামুকতা থেকে মুক্ত। পুরুষ সেটা জানে এবং সে চায় নারী হতে। কিংবা নারীর মতো হতে। কিন্তু এই চাওয়া তার অহংবোধে আঘাত দেয়। তাই সে এই চাওয়াকে ঢেকে রাখার জন্য আগ্রাসী ও হিংসাত্মক হয়ে ওঠে এবং নারীকে বশীভূত করে রাখতে চায়। কিন্তু নারী যদি সত্যিকার নারী হয় অর্থাৎ নারী যদি স্বাধীন, সাহসী ও মেধাবী হয়, তাহলে তাকে তো বশ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সুতরাং পুরুষ চেষ্টা করে নারীকে সত্যিকার পুরুষের মতোই ভীরু, অনুৎপাদনশীল ও পুরুষের উপর নির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে। একই সঙ্গে পুরুষ নিজে নারীর ইতিবাচক গুণগুলো আয়ত্ত করে ও সেগুলোকেই পুরুষের গুণ হিসেবে চালিয়ে দেয়। অর্থাৎ সোলানাস বলতে চাইছেন যে, আধুনিক পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোনো পুরুষই সত্যিকার পুরুষ নয় এবং কোনো নারীই নয় সত্যিকার নারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষকে নারীতে এবং নারীকে পুরুষে পর্যবসিত করছে। সিমোন দ্য বেভোয়াঁর সেই বিখ্যাত উক্তি আমরা সবাই জানি, ‘কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, সে নারী হয়ে ওঠে।‘ সোলানাস এই ‘হয়ে ওঠা’টাকে স্বীকার করে নিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর দাবি হলো, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের গড়ে তোলা হিংসাত্মক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক গ্যাড়াকলে পড়ে নারী হয়ে ওঠে পুরুষ এবং পুরুষ হয়ে ওঠে নারী (পুরুষ যে অনুপাতে সৃষ্টিশীল ও স্বাধীন, সেই অনুপাতে সে নারী; নারী যে অনুপাতে অসৃষ্টিশীল ও বশ্য, সেই অনুপাতে সে পুরুষ)। নারীরাও সেটা মেনে নেয়, কারণ তা ছাড়া তার গত্যন্তর থাকে না। ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিগ ড্যাডি তার নিজের স্বার্থে অসংখ্য ড্যাডিজ গার্ল তৈরী করে যান, যাদের কাজই হলো পুরুষের অনুগত থেকে তার সর্বাত্মক সন্তুষ্টি বিধান করে যাওয়া এবং বিশেষ করে তার কামক্ষুধাকে তৃপ্ত করা। যে নারীরা পুরুষের বশ মানতে চান না, তারা হলো স্কাম। যেমন, সোলানাস নিজে।
এই গণেশ উল্টে দেওয়ার ব্যাপারটা বেশ মজাদার, সন্দেহ নেই। এরচেয়ে বেশি কৌতুহলোদ্দীপক হলো সোলানাসের বিশুদ্ধ নারীর আর্কিটাইপ, যাকে অনেকটাই বাড়াবাড়ি বলে মনে হয় অনেকের কাছে। ঠিক এই জায়গায় এসে আমাদের মনে পড়ে যায় এক ক্ষণায়ু জার্মান দার্শনিকের কথা। অটো ওয়েনিঙ্গার যার নাম। যিনি দাবি করেছিলেন, কোনো মানুষই তার মনস্তত্ত্বে ও জীবনাচরণে শতকরা একশো ভাগ পুরুষ কিংবা একশো ভাগ নারী নয়। প্রতিটি মানুষই কিয়দংশে নারী ও কিয়দংশে পুরুষ। মানুষের নৈতিক, যৌক্তিক ও সৃষ্টিশীল দিকগুলোকে তিনি পুরুষসূচক বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। পক্ষান্তরে মানুষের অসৃষ্টিশীল, অক্রিয়, অযৌক্তিক ও অচেতন দিকগুলোকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য হিসেবে। অর্থাৎ ওয়েনিঙ্গারের অবস্থান ছিলো সোলানাসের ঠিক বিপরীতে। এবং তার পরিণতিও হয়েছিলো ঠিক বিপরীত, মরণোত্তরকালে ‘নারীবিদ্বেষী’ হিসেবে ওয়েনিঙ্গার কুখ্যাতি লাভ করেছিলেন। পক্ষান্তরে সোলানাস আজ স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর সুস্পষ্ট ও প্রমাণিত পুরুষবিদ্বেষের জন্য। শৈশবে সোলানাস নিয়মিত তার পিতার যৌন লালসার শিকার হয়েছেন। আর কৈশোরে নির্যাতিত হয়েছিলেন পিতামহের হাতে। পিতামহের গৃহ থেকে পালানোর পর গৃহহীন জীবন যাপন করতে বাধ্য হন তিনি এবং জীবনধারণের জন্য এ সময় এমনকি পতিতাবৃত্তির শরণ নিয়েছিলেন (যদিও আদতে তিনি ছিলেন লেসবিয়ান)। এক নাবিকের ঔরসে জন্ম দিয়েছিলেন এক পুত্র-সন্তানের। কিন্তু সেই পুত্রকে শিশু অবস্থাতেই কেড়ে নেওয়া হয় তার কাছ থেকে এবং জননী হয়েও তিনি তার সন্তানের মুখ আর কখনো দেখতে পাননি। ব্যক্তিগত জীবনের এই সমস্ত ট্রাজেডির নিশ্চয়ই এক বড়ো ভূমিকা রয়েছে সোলানাসের পুরুষবিদ্বেষী হয়ে ওঠার পেছনে। Up Your Ass-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র বঙ্গি পেরেজ আসলে সোলানাস নিজেই। এই লেসবিয়ান পতিতার চরিত্রের মাধ্যমে তিনি আসলে নিজেকেই চিত্রিত ও বিবৃত করেছেন এবং রাগ ঝেড়েছেন সমগ্র পুরুষজাতির উপর।
কিন্তু এই পুরুষবিদ্বেষই শেষ কথা নয়। পুরুষের মুণ্ডপাত করতে করতেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের হিংসা ও আধিপত্যের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন সোলানাস। এবং তিনি যখন পুরুষকে হত্যা করার কথা বলেন, তখন তিনি আসলে ওই হিংসাত্মক ও নেতিবাচক পুরুষত্বকেই হত্যা করার কথা বলেন, যেটা ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক উভয় পর্যায়েই নারীকে বশীভূত করে রাখতে চায়, নারীকে হীন করে তুলতে চায়। এই কারণেই তিনি বলেছেন, পুরুষের হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে কেবল পুরুষকে হত্যা করলেই চলবে না। বরং যে সকল প্রতিষ্ঠান এই হিংসাত্মক পৌরুষের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ধ্বংস করতে হবে। এইখানেই সোলানাস অনন্য। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় পুরুষের সমান হতে হলে পুরুষের মতোই হয়ে উঠতে হবে নারীকে। সোলানাস সেটা চান না। তিনি চান সম্পূর্ণ নতুন এক সমাজ যেখানে ভালোবাসা, সহানুভূতি ও বন্ধুত্বের ভিত্তিতে মানুষ মানুষের সঙ্গে মিশবে, উঠবে, বসবে, চলবে। এমন এক সমাজ, যেটা নেহাত কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি ও পরিবারের নিরাসক্ত সহাবস্থান মাত্র নয়। এই আদর্শ, ইউটোপিয়ান সমাজের কথা মাথায় রেখেই তিনি পুরুষতান্ত্রিক জীবন-ব্যাকরণকে আক্রমণ করেছেন, চেয়েছেন গণেশ উল্টে দিতে।
তবে সোলানাসই প্রথম নন। আদি ও আধুনিক অনেক নারীবাদীই এইভাবে গণেশ উল্টে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। উদাহরণস্বরূপ, বেগম রোকেয়া তাঁর ‘সুলতানার স্বপ্ন’ লেখেন ১৯০৫ সালে। সেখানে পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অনেক প্রতিষ্ঠিত ন্যারেটিভকে আক্রমণ করেছেন কঠোরভাবে। অনেক ক্ষেত্রেই রোকেয়ার অবস্থান সোলানসের সঙ্গে মিলে যায়। সোলানাস চাইতেন কায়িক শ্রমের বিলুপ্তি এবং আধুনিক প্রযুক্তির দ্বারা কায়িক শ্রমের সর্বাত্মক প্রতিস্থাপন। দেখা যাচ্ছে, রোকেয়াও চাইছেন কর্মঘণ্টা কর্মদিবস দু’ঘণ্টায় নামিয়ে আনতে। রোকেয়ার লেডিল্যান্ডে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় না। কারণ সমস্ত অপরাধের গোড়া যে পুরুষ, সেই পুরুষ সেখানে গৃহবন্দী জীবন যাপন করে। লেডিল্যান্ডে কোনো হিংসা নেই, প্রতিযোগিতা নেই। কারণ পুরুষ সেখানে নারীর অনুগত এবং নারীসুলভ ইতিবাচক আবেগ-অনুভূতিরই সেখানে জয়জয়কার। অর্থাৎ ভিন্ন এক যুগ ও ভিন্ন এক পরিবেশের মানুষ হয়েও রোকেয়া প্রায় একই রকম তীব্রতার সাথে পুরুষতন্ত্রের ব্যকরণকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে চেয়েছেন।যদিও সোলানাসের তুলনায় রোকেয়াকে আরো সংহত, আরো পরিণত মনে হয়। এবং রোকেয়া তাঁর শেষ জীবনের কিছু স্ববিরোধিতা সত্ত্বেও, বিপ্লবী নারীবাদীদেরই একজন। সোলানাস নিজেকে বলতেন স্কাম। “আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ওই ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে”- স্কাম রোকেয়ার স্কাম হওয়ার প্রমাণ হিসেবে এই একটি উক্তিই যথেষ্ট।
একই রকম প্রবণতা আমরা দেখতে পাই চীনা নারীবাদী ও নৈরাজ্যবাদী হে ইন জেনের লেখায়। তাঁর ১৯০৭ সালে লেখা ‘The Feminist Manifesto’-তে আমরা দেখছি যে, তিনিও কোনো সংস্কার বা মামুলি পরিবর্তন চান না।চান আমূল সামাজিক বিপ্লব। সেই বিপ্লবের পর নারীরা শিশুপালনের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাবে এবং পুরুষের সমান মর্যাদা ও সুযোগ লাভ করবে প্রতিটি পেশায় এবং সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে। পুরুষতন্ত্র সেই বিপ্লবের বিরোধিতা করবে নিশ্চয়ই। কিন্তু প্রতিটি বিপ্লবের ক্ষেত্রেই যেমন হয়, জোর খাটিয়ে তাকে পদানত করতে হবে। কেটি ডিপওয়েল সম্পাদিত Feminist Art Manifestos: An Anthology- বইয়ে আমরা এই জাতীয় আরো অনেক ম্যানিফেস্টোর সন্ধান পাবো। যেখানে কেউ কেউ রয়ে-সয়ে, আবার কেউ কেউ সোজা ভাষায় গণেশ উল্টে দিতে চাইছেন, স্বপ্ন দেখছেন ভিন্ন এক বাস্তবতা নির্মাণের।
একটা জিনিস স্পষ্ট। রোকেয়া কিংবা সোলানাসেরা মানুষ পুরুষের উপর ক্ষিপ্ত তো বটেই, তবে তারা বেশি ক্ষিপ্ত পুরুষতন্ত্রের সেই ব্যাকরণের উপর, যে ব্যাকরণ আদর্শ নারী ও আদর্শ পুরুষের একটা মডেল ধরিয়ে দেয় সবার হাতে এবং সবাইকে সেই মডেল অনুসরণ করতে বাধ্য করে। জেন্ডার-ভিত্তিক পরিচয়ের এই মডেলের বিরুদ্ধেই রোকেয়া কিংবা সোলানাসের প্রধান আপত্তি। তাঁরা ভেঙে ফেলতে চান পরিচয়ের সেই কাঠামো, যেখানে পুরুষ সর্বাত্মক চেষ্টা করে যায় একজন আগ্রাসী, শক্তিশালী ও আক্রমণাত্মক পুরুষ হয়ে উঠতে। আর নারীরা হয়ে উঠতে চায় (বা হয়ে উঠতে হয়) অনুগত, আবদ্ধ ও প্রজননসর্বস্ব। তাঁরা সেই সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যেখানে একটা বাঁধাধরা লৈঙ্গিক পরিসরের বাইরে কেউই যেতে পারে না। যেখানে কোনো ব্যতিক্রম ও বৈচিত্র্য সহ্য করা হয় না। সাম্প্রতিক কালের অনেক নারীবাদীই এই জেন্ডার-ভিত্তিক পরিচয়-কাঠামোর বিলোপ-সাধনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। তাদের কথা হলো, পুরুষকে নয়, হত্যা করতে হবে জেন্ডারকে।
জেনোফেমিনিজম কিংবা জেন্ডার নিহিলিজমের মতো আন্দোলনগুলোর মূল কথা আসলে এটাই। জেন্ডারকে বিলুপ্ত করতে হবে। এই ধারণাগুলোর প্রবক্তারা হয়তো নীৎশের মতোই বলে উঠতে চান, Gender is dead. We have (to) kill(ed) gender. সমস্যা হচ্ছে, বিষয়টা এতো সহজ নয়। মানুষের মনস্তত্ত্বে ও জীবনাচরণে জেন্ডার এতো গভীরভাবে শিকড় গেড়ে আছে যে সবচেয়ে শোষিত যে নারী, সবচেয়ে হুমকিগ্রস্ত যে সমকামী নারী কিংবা পুরুষ, এমনকি তিনিও হয়তো জেন্ডার বিলুপ্তির এই ধারণাকে অসম্ভব ও অযৌক্তিক মনে করবেন। মানুষের অনেক সংস্কার ও কুসংস্কারের মতোই লৈঙ্গিক পরিচয়ও হয়তো একটা ভ্রম মাত্র, যাকে মানুষ যেকোনো মূল্যে আঁকড়ে ধরতে চায়। এমনকি যখন সে শোষিত হয়, তখনো। আরো দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমরা এমন একটা যুগে বাস করছি, যখন মানুষের সহমর্মিতা ও সহনশীলতা আশঙ্কাজনক মাত্রায় কমে যাচ্ছে। শুধু তা-ই না, মানুষ যাতে সহনশীল না হয়, সেজন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে বিভিন্ন স্তরের সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি। কারণ মানুষের মধ্যে বিরোধ ও বিভক্তি থাকলে, সেটা শাসকেরই লাভ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও, জেন্ডার হয়ে উঠেছে বর্তমান যুগে শাসন ও শোষণের অন্যতম বড়ো হাতিয়ার। মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, মানুষকে দমিয়ে রাখার জন্য জেন্ডার-ভিত্তিক পরিচয়-কাঠামোকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এ যুগে। পুরুষ, নারী কিংবা তৃতীয় লিঙ্গ এই কাঠামোর ভেতরেই একেকটা ক্যাটেগরি। প্রতিটা ক্যাটেগরির জন্যই কিছু লিখিত ও অলিখিত অনুশাসন ও আচরণবিধি ঠিক করে দেওয়া হয়েছে, যার বাইরে গেলেই রাষ্ট্র কিংবা সমাজ বিনা বাক্যব্যয়ে হস্তক্ষেপ করছে নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবনের উপর। এই কাঠামোটা এমনই যে এখানে ক্যাটেগরির সংখ্যা বাড়িয়ে যেমন লাভ নেই, কমিয়েও তেমনি লাভ নেই। কারণ যেকোনো স্বীকৃত ক্যাটেগরিই শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের শোষণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। সুতরাং কোনো বিশেষ ক্যাটেগরি নয় বরং পুরো মানদণ্ড, তথা পুরো কাঠামোটিকেই ভেঙে ফেলতে হবে। যে সমস্ত ধারণা ও প্রতিষ্ঠান এই কাঠামোর ভিত হিসেবে কাজ করছে, তাদেরকেও ভেঙে ফেলতে হবে। এই কারণেই জেনোফিমিনিজম প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। কারণ আধুনিক সমাজে প্রকৃতিও শেষ বিচারে পুঁজিবাদ ও পুরুষতন্ত্র-প্রভাবিত একটি ধারণা হয়ে ওঠেছে। পুরুষ প্রাকৃতিকভাবেই এরকম, নারী প্রাকৃতিকভাবেই ওরকম, সমকাম প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ, প্রভৃতি ন্যারেটিভ দাঁড় করানোর মাধ্যমে একটা আপাত-অরাজনৈতিক আচরণবিধি তৈরী করতে চাওয়া হয় আজকের সমাজে।যদিও তার পেছনে থাকে একটি সক্রিয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। জেনোফিমিনিস্টরা বলছেন, প্রকৃতি যদি শোষণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তো প্রকৃতিকেই বদলে দাও। প্রকৃতির সামনে নতজানু হওয়া কিংবা অপরাধবোধে ভোগার কোনো কারণ নেই।
তবে আগেই যেমন বলা হয়েছে, বিষয়টা সহজ নয়। মানুষের মুক্তি সম্ভব কিনা, এরচেয়ে বড়ো প্রশ্ন হলো মানুষ মুক্তি চায় কিনা এবং মানুষ অন্যের মুক্তি চায় কিনা। সাম্য ও স্বাধীনতার আকাঙ্খা যদি সমাজের ভেতর থেকে ওঠে না আসে, তো নারীর সাম্য ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কোনো প্রচেষ্টাই শেষ অব্দি সফল হবে না। এটা এক প্রকার নিশ্চিত যে, বিদ্যমান ব্যবস্থা আমাদেরকে আর ধারণ করতে পারছে না। সে চাইছে আমাদেরকে উগরে দিতে। কিন্তু এরপরও এই ব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়, যদি মানুষ আন্তরিকভাবে সেই পরিবর্তন না চায়। ছড়ি ঘুরিয়ে যেমন কাউকে উদার বানানো যায় না, তেমনি আইন প্রণয়ন করে কোনো অপরাধ কিংবা কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করা যায় না। এর মানে অবশ্য এই নয় যে, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রচেষ্টার কোনো দরকার নেই। দরকার তো অবশ্যই আছে। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে, সমস্যার গোড়া আমাদের সমাজে। জেন্ডার-ভিত্তিক যে পরিচয়-কাঠামো আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা এক দিনে গড়ে ওঠেনি। বহু প্রথা ও বহু সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত ভিত্তির উপর শত শত বছর ধরে গড়ে ওঠেছে এই কাঠামো। তার সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপ। আজকের যুগে ডিকলোনিয়াল ফেমিনিস্টরা আমাদের দেখাচ্ছেন যে, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি অন্য সবকিছুর মতোই বিশ্বের বিভিন্ন সমাজের জেন্ডার-কাঠামোতেও নিজেদের ছাপ রেখে গেছে। আশিষ নন্দী তাঁর ‘The Intimate Enemy’ বইতে দেখিয়েছেন কিভাবে ইউরোপের আগ্রাসী ও আক্রমণাত্মক পৌরুষের ধারণা আধুনিক ভারতের জেন্ডার-কাঠামোকে প্রভাবিত করেছে এবং তাকে বদলে দিয়েছে অনেকাংশে। সুতরাং সমস্যার মূল আরো গভীরে এবং এর কোনো সহজ, সরল সমাধান নেই।
ভালেরি সোলানাস কিংবা বেগম রোকেয়ারা যে সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই সমাজ হয়তো নিছক ইউটোপিয়া। কিন্তু আমরা যদি একটা যথাসম্ভব সুন্দর ও শোষনমুক্ত পৃথিবী গড়ে তুলতে চাই, তার জন্য আমাদেরকে সমাজের ভেতরে গিয়ে কাজ করতে হবে। নারীমুক্তির জন্য শক্ত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত গড়ে তুলতে না পারলে কেবল আনুষ্ঠানিকতা-সর্বস্ব নারীবাদ ও কপট রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা যে আমাদেরকে কিছুই দিতে পারবে না, তার প্রমাণ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। সেই ভিত নির্মাণ যতো কঠিন ও সময়সাপেক্ষই হোক, সেটা করতে হবে। ভালেরি সোলানাসকে যদি আমরা ঠিকভাবে বুঝতে পারি, তো এটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, ঢালাও অর্থে Society for Cutting Up Men নয়। বরং বৃহত্তর অর্থে Society for Cutting Up Gender-ই পারে নারী ও পুরুষ উভয়কেই পুরুষতন্ত্রের যাবতীয় অত্যাচার ও বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিতে।
তথ্যসূত্র:
1.Deepwell, K. (Ed) (2014). Feminist Art Manifestos: An Anthology. KT Press
2. Solanas, V. (1971). The SCUM Manifesto, The Olympia Press
3. Peltonen, S., Lindman, M. & Nyman, S. (2017) Perceiving Shit as Shit: On the Grammar of Patriarchy in Solanas’ SCUM Manifesto. Feminist Encounters: A Journal of Critical Studies in Culture and Politics, 1(1), 09
4. Fahs, B. (2008) The Radical Possibilities of Valerie Solanas. Feminist Studies 34. No. 3 (Fall 2008)
5. Zehn H. (2020) The Feminist Manifesto, Pattern Books
6. Bugge, M. (2015) Writing Violence: The Feeling Politics of Valerie Solanas, feral feminisms: Feminine Feelers, issue 3 . winter 2015
7. Solanas, V. (2021) Up Your Ass; and A Young Girl’s Primer on How to Attain to the Leisure Class, Dracopis Press
8. Nandy, A. ( 1983) Intimate Enemy: Loss and Recovery of Self Under Colonialism, Oxford University Press
9. Cuboniks, L. (2018) The Xenofeminist Manifesto: A Politics for Alienation, Verso
10. Lugones, M. (2010) Toward a Decolonial Feminism. Hypatia vol. 25, no. 4 (Fall 2010)
11. Escalante, A. (2015) Gender Nihilism: An Anti-Manifesto. Libcom.org
12. Weininger, O. (2005) The Intimate Enemy: Loss and Recovery of Self Under Colonialism, Indiana University Press