গোলাপী বর্মণ একজন তৈরি পোশাক শ্রমিক। তিনি সুদূর চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে সাভারে কারখানায় কাজ করতে এসেছেন। তার ৫ বছরের কর্মজীবনে কয়েকটি কারখানায় কাজ করেছেন। তার স্বামীও একজন শ্রমিক। গোলাপী বর্মণের কর্মজীবন, সংসার, মোটকথা প্রাত্যহিক জীবন সংগ্রাম নিয়ে আলাপ করেছেন নারী অঙ্গনের বিশেষ প্রতিনিধি কাউসার ফরাজী।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি: দিদি, আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?
গোলাপী বর্মণ : চাপাই
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : দিদি, আপনার ফ্যামিলিতে কে কে আছেন?
গোলাপী বর্মণ : স্বামী, এক ছেলে, এক মেয়ে আর শ্বাশুড়ি আছেন।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : আপনার বিয়ে হয়েছে কত বছর হবে?
গোলাপী বর্মণ : হইছে, মেয়েরে বিয়া দিছি, ছেলে ছোড, পাঁচ বছর।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : আপনি পড়াশোনা করেছেন, দিদি?
গোলাপী বর্মণ : বেশি পাই নাই পড়াশোনা করতে, বিয়ে হইছে যে কম বয়সে।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : আপনি যে কারখানায় কাজ করেন, এটা কি বিয়ের আগে থেকে, নাকি বিয়ের পর থেকে?
গোলাপী বর্মণ: বিয়ের পর থেকে।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : আপনার স্বামী কী করেন, দিদি?
গোলাপী বর্মণ : এই জায়গায় লোডারের কাজ করে।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : দুইজনে মিলে কত টাকা বেতন পান? ভালো টাকাই তো মনে হয় বেতন পান?
গোলাপী বর্মণ : হ, ওর তো ওভারটাইম হয় না। মনে করেন ওর তো চৌদ্দ, আর আমি বেতন সাড়ে তেরো, আর ওভারটাইম মিলিয়ে আমার পড়ে সাতাইশ/আটাইশ হাজার ।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : আপনারা ভাই বোন কয়জন?
গোলাপী বর্মণ : আমি একলাই, ভাই-বোন কেউ নাই।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : আপনার মা-বাবা?
গোলাপী বর্মণ: আব্বা আছে, মা মারা গেছে।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : আপনার বাবা বিয়ে করেছে পরে আবার?
গোলাপী বর্মণ : করছে, কিন্তু বাচ্চা কাচ্চা নাই, একটা বাচ্চা হইছিলো কিন্তু মারা গেছে, পরে আর হয় নাই।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : আপনার বাবার সম্পত্তি আছে না, দিদি?
গোলাপী বর্মণ : না, গরীব মানুষ আমার বাবা। ঘর বাড়িও নাই, পরের জায়গাত থাকে। শাও এলাকার লোক তো, শাওয়ত পুরে জাগার দর বেশি।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : আপনি এখানে কতো বছর ধরে কাজ করেন?
গোলাপী বর্মণ: এইহানে ৬ মাস।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : আপনি টোটাল কত বছর ধরে গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করেন?
গোলাপী বর্মণ: কই বছর! ধরেন পাঁচ বছর, ছেলে হওয়ার তিন মাস পর গার্মেন্টসে ঢুকছি।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : ছেলে হওয়ার তিন মাস পরেই কারখানায় কাজে ঢুকছেন?
গোলাপী বর্মণ: কষ্টের দিন ছিল তো।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : এখন ছেলে বাড়িতে কার সাথে থাকে?
গোলাপী বর্মণ: শাশুড়ি নিয়ে থাকে, বয়স্ক।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি :আপনার ছেলে তো আপনার শাশুড়ির কাছে থাকে, আপনারা একজনও তো ওকে সময় দিতে পারেন না, তাহলে ওর পড়াশোনা কীভাবে হবে?
গোলাপী বর্মণ: এহনো স্কুলে ভর্তি লয় নাই, খাটো তো, শয়তানিডা বেশি করে। সামনে বার ইস্কুলে দিমু।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি: আপনারা স্বামী স্ত্রী তো ভাড়া বাসায় থাকেন, তাই না?
গোলাপী বর্মণ: হুম।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি :বাসা ভাড়া কত দেন মাসে?
গোলাপী বর্মণ: ৩৪০০ টাকা, খাবার দাবার খরচ পরে গিয়া ১৫ হাজার টাকা।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : দুজনে একসাথেই তো কাজে আসেন, বাড়িতে রান্না বান্না করে কে?
গোলাপী বর্মণ: আমি সকালে রান্না করি, ও রাইতে রান্না করে।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : আপনার স্বামী রাতে রান্না করেন?
গোলাপী বর্মণ: হ, ওর ছুটি হয় রাত আটটায়, কোন সময় দশটায় হয়।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : গত রাতে বাসায় গিয়ে কী দেখলেন? আপনার স্বামী কী রান্না করেছেন?
গোলাপী বর্মণ: ডাল, আলুভাজি, ডিমের ভাজি বানাইছে।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : এখানে সকাল কয়টায় আসেন, আর রাত কয়টায় যান?
গোলাপী বর্মণ : সকাল ৮ টায় আসি, আর রাইত ১২ টা পর্যন্ত কাজ করে বাসায় যাই।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : এই যে কারখানায় এতো ডিউটি করেন, সকাল আটটায় এসে রাত ১২ টায় যান, অসুস্থ হয়ে পড়েন না?
গোলাপী বর্মণ : অসুস্থ ওবো না! পা ফুলি যায়, প্রতি রাইতে পা ফুলি যায়। আগে ব্যথা করতো না, এহন ব্যথাও করে। দাঁড়ায় থাইকা, বইয়া থাকলেও এহন পা ভারী হইয়া যাইতাছে।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : এই যে পা ব্যথা করে, অসুস্থ হলে ছুটি দেয় আপনাদেরকে?
গোলাপী বর্মণ: ছুডি লাই নাই। এই জায়গায় এসে একবারও ছুটি লাই নাই।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : আগে কোন কারখানায় ছিলেন?
গোলাপী বর্মণ: আল মুসলিমে।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : ওইখানে ছুটি দিতো আপনাদেরকে?
গোলাপী বর্মণ : ওই জায়গায় এইটা ভালো ছিলো, ছুডি দিতো অসুস্থ হইলে। একবার চোখ উঠছিলো, তখন ছুডি দিছিলো। দুইবার এক্সিডেন্ট হইছিলো, প্রথমবার তিন দিনের ছুডি দিছিলো, পরের বার মনে করেন বেশি এক্সিডেন্ট হইছিলো তো, ওরা ডাক্তার দেখিয়ে শুধু ওষুধ দিছিলো আর একবেলা মনে হয় ছুডি দিছিলো।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : আল মুসলিমে কি আপনার প্রথম চাকরি?
গোলাপী বর্মণ :না। এমপিঠানের ওইহানে একটা গার্মেন্টস আছে, ওইহানে হেল্পার আছিলাম।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : হেল্পার ছিলেন কত দিন?
গোলাপী বর্মণ : হেল্পারি করছি এক বছরের মতো, চার বছরের মতো অপারেটরি।
নারী অঙ্গন প্রতিনিধি : বর্তমান কারখানায় অসুস্থ হলে কি কোনো চিকিৎসা, সুযোগ সুবিধা দেয়?
গোলাপী বর্মণ: জানি না, বলতো পারবো না, একদিনও যাই লাই।
খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লাম গোলাপি আপার কথাগুলো।
এ রকম সংগ্রামী জীবনকথাই আমাদের অনুপ্রেরণা।
ধন্যবাদ নারী অঙ্গনকে।