বিশ্বব্যাপী নারীবাদের চতুর্থ তরঙ্গ চলমান। রোকেয়া ছিলেন প্রথম তরঙ্গের একজন নারীবাদী। নারীদের ভোটাধিকার ও শিক্ষাদীক্ষা থেকে দূরে রেখে গৃহকোণে অবরুদ্ধ করে রাখার বিরুদ্ধে কামান দাগিয়েছিল প্রথম তরঙ্গ। রোকেয়ার সমস্ত লেখা ও ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতেও ছিল গৃহকোণে অবরুদ্ধ বাঙালি মুসলিম নারী তথা ভারতবর্ষের সকল নারীর দাসত্ব, অসহায়ত্ব, অক্ষমতা, অদক্ষতা, দুর্বলতা, যন্ত্রণার মর্মন্তুদ চিত্র উপস্থাপন এবং শিক্ষার মাধ্যমে তাদের মানসিক ও জাগতিক দাসত্ব থেকে মুক্তির উপায় তালাশ।
রোকেয়ার লেখা পড়লে মনে হতে পারে, তিনি পশ্চিমা নারীবাদী মেরি ওলস্টোনক্রাফট দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কেউ কেউ এমনটা ভেবেও থাকেন। কিন্তু “মতিচূর” এর দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় ‘মতিচূরের ভাব ও ভাষা অন্যান্য খ্যাতনামা গ্রন্থকারদের গ্রন্থ হইতে গৃহীত হইয়াছে’ বলে পাঠকদের সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে রোকেয়া জানান, ‘এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়’। কোন কোন উর্দু প্রবন্ধ, ইংরেজি উপন্যাসের মধ্যেও ‘মতিচূরের ভাবের ঐক্য’ দেখতে পেয়েছেন রোকেয়া। এর পরেই পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখেছেন,’বঙ্গদেশ, পঞ্জাব, ডেকান, বোম্বাই, ইংলণ্ড –সর্ব্বত্র হইতে একই ভাবের উচ্ছ্বাস উত্থিত হয় কেন?’ নিজেই আবার জবাব দিয়েছেন, ‘অবলাবৃন্দের আধ্যাত্মিক একতা।’ নারীদের জন্য হৃদয়ের গভীর তলদেশ থেকে উত্থিত মর্মবেদনা, গভীর সহানুভূতি, ভালোবাসা ছাড়া কেবল কারো লেখা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমন ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’ পারি দেয়া কিছুতেই সম্ভব হতো না রোকেয়ার পক্ষে, কারো পক্ষেই সম্ভব না। কয়েক বছর ধরে নারীদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে এবং বিশ্বের খ্যাতনামা নারীবাদী লেখকদের লেখা পড়তে গিয়ে প্রায়শই মনে হয়,
একই বৃক্ষতলে গিয়েছি আমিও
কোঁচা ভরে কুড়িয়েছি
চুক্কা কূল আর আম্র।
একেই হয়তো রোকেয়া বলেছিলেন, ‘অবলাবৃন্দের আধ্যাত্মিক একতা।’
হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে ভারতবর্ষের নারীরা যখন বাল্যবিবাহ ও অবরোধ প্রথার বলী, শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত, নানাবিধ কুসংস্কার দ্বারা চালিত, তখন নারীদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বিষয়টি রোকেয়ার নজরে এলেও, শিক্ষার প্রতি প্রায় সবটুকু মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ যাদের শিক্ষা নেই, ভালো -মন্দ বিচার করার বোধ নেই, সব দিক দিয়ে অন্যের উপর নির্ভরশীল, তাদেরকে সম্পত্তির কথা বলে আসলে তেমন কোন লাভও ছিল না। এরপরও ১৯০২ সালে লেখা এবং ১৯২৪ সালে পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত ও পরিবর্জিত আকারে প্রকাশিত রোকেয়ার “পদ্মরাগ” উপন্যাসের পুরো প্লটই দাঁড়িয়ে আছে নায়ক লতিফ আলমাসের না-শরীক আইনের বলী হওয়ার উপর। পিতামহের বর্তমানে শৈশবে পিতার মৃত্যুর কারণে পৈত্রিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফল কেবল সে ও তার পুরো পরিবার নয়, তার পরিবারের সাথে যুক্ত সিদ্দিকা( জয়নব) ও তার পরিবারকেও ভুগতে হয়েছে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। এ উপন্যাসের প্লট নির্বাচন থেকেই বুঝা যায়, এই অযৌক্তিক ও অন্যায্য আইন রোকেয়াকে কতোটা স্পর্শ করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে আইয়ুব খানের সরকার পাকিস্তান থেকে এই আইন বাতিল করেছে।
সেই সময় রোকেয়া সরাসরি পৈত্রিক সম্পত্তিতে মুসলিম নারীর সমান উত্তরাধিকারের উপর আওয়াজ তুলতে না পারলেও, একাধিক লেখায় ( অর্দ্ধাঙ্গী, ভ্রাতা-ভগ্নী, রানী ভিখারিনী) আকারে ঈঙ্গিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন অর্ধেক উত্তরাধিকারের আইন নিয়ে । ‘ভ্রাতা-ভগ্নী’ গল্পে অসুস্থ ও বৃদ্ধা মা’কে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অন্যত্র নিয়ে যাওয়া নিয়ে দুই বোন সিদ্দিকা ও সুফিয়ার সাথে বিলেত ফেরত ভাই কাজেবের বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে কাজেব সুফিয়াকে বলে, ‘সুফিয়া, তুমি আর ক্ষীরে লুন দিও না। তোমরা দুইজন-আমি একা!’ তখন সুফিয়ার কণ্ঠ দিয়ে যেন রোকেয়ারই ক্ষেদোক্তি বেরিয়ে আসে, ‘তুমি একাই আমাদের দুইজনের সমান।’
এই অর্ধেক সম্পত্তির ভাগীদার করাও যে একটা প্রহসন, সেটাও রোকেয়ার দৃষ্টি এড়ায়নি। ‘মুসলমানদের মতে আমরা পুরুষের “অর্দ্ধেক”, অর্থাৎ দুইজন নারী একজন নরের সমতুল্যা।… যদি আপনারা একটু পরিশ্রম স্বীকার করিয়া কোন ধনবান মুসলমানের সম্পত্তি বিভাগ করা দেখেন, কিম্বা জমিদারী পরিদর্শন করিতে যান, তবে দেখিবেন কার্য্যত: কন্যার ভাগে শূন্য (০) কিংবা যৎসামান্য পড়িতেছে’ (অর্দ্ধাঙ্গী)। শুধু তাই না, ‘মুসলমানেরা কন্যার দ্বারা সম্পত্তিতে লা-দাবী লিখাইয়া লইয়া কন্যাকে বিষয়ের অংশ হইতে বঞ্চিত করেন। নানাবিধ জঘন্য উপায়ে নারীকে পিতা ও স্বামীর সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত করা হয়।’
কয়েক বছর পরে রোকেয়ার জন্মের সার্ধশতবর্ষ পালিত হবে। কিন্তু আজও বাংলাদেশের হিন্দু -মুসলিম -বৌদ্ধ নারীরা পুরুষের সমান হিসেবে আইনী স্বীকৃতি পায়নি, পায়নি সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকার। হিন্দু ও বৌদ্ধ নারীরা তো অর্ধেক ভাগও পায়নি। আর মুসলিম নারীদের অর্ধেক অংশও আজও কাজীর গরু কিতাবেই আছে, গোয়াল প্রায় শূন্য। সম্পত্তি ‘লা-দাবী লিখে দে’ এবং সারা জীবন দেনমোহর বাকি রেখে তালাক দিয়ে বউকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার সময় ‘দেন-মোহর মাফ করে দিয়ে যা’ দৃশ্যের স্বাক্ষী আজও আমাদের হতে হয়।
রোকেয়ার আমলে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার কথা বললে বলা হতো ‘শিক্ষা পেলে স্ত্রীলোক অশিষ্ট ও অনম্য হয়’। আর আমাদের আমলে সম্পত্তির সমান ভাগ চাইলে বলা হচ্ছে, ‘মেয়েদের সম্পত্তির সমান ভাগ দিলে সংসারে বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে এবং বোনের উপর অভিশাপ লাগবে’। রোকেয়া নারী- শিক্ষা বিরোধীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘যদি শিক্ষা পাইয়া পুরুষগণ বিপথগামী না হয়, তবে স্ত্রীলোকেরা কেন বিপথগামী হইবে’ (বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতি)। আমরাও সম্পত্তির সমান ভাগ দিতে না চাওয়া সমাজকে বলতে চাই, ভাইদের মধ্যে সম্পত্তির সমান ভাগ হওয়ার ফলে যদি সংসারে বিশৃঙ্খলা দেখা না দেয় এবং ভাইদের উপর অভিশাপ না লাগে, তাহলে বোনরা পেলে সংসারে বিশৃঙ্খলা কেন দেখা দিবে? কেন বোনদের উপর ভাইদের অভিশাপ লাগবে? বোনরা কি ভাইদের সম্পত্তি নিতে চায়? তারা ভাইদের কাছে থাকা নিজেদের সম্পত্তি চায়।
অনুন্নত পুঁজিবাদ, প্রকট শ্রেণি বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্যের এই বাংলাদেশে জনগণের জন্য নূন্যতম নাগরিক অধিকারও নিশ্চিত করতে পারছে না রাষ্ট্র। নাগরিকরা জোরের সাথে তাদের অধিকারগুলো দাবিও করতে পারছে না। যারা এই একবিংশ শতকে এসেও নিজের বোন ও ফুফুকে সম্পত্তিতে সমান অধিকার দেওয়াকে সমর্থন করতে পারে না, তারা রাষ্ট্রের কাছে সমান নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা দাবি করবে কোন হিসেবে? কোন নৈতিক বলে? হযরত ঈসা ( আ:) বলেছেন, ‘তুমি নিজে অপরের নিকট যেরূপ ব্যবহার পাইতে ইচ্ছা করো, অপরের সাথে সেইরূপ ব্যবহার করিও।’
“বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতি” প্রবন্ধে রোকেয়া ভারতের ৩ কোটি বাঙ্গালি মুসলমানের মধ্যে মাত্র ১ জন নারী গ্রাজুয়েট থাকার কথা উল্লেখ করে হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। এখন বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে পর্যন্ত ঘরে ঘরে গ্রাজুয়েট, পোস্ট-গ্রাজুয়েট নারীর অভাব নেই। এরপরও আজও আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে দলবেঁধে কান্নাকাটি করতে হয়, আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোতে এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্যে গঠিত কমিশনে নারী সদস্য নেই বলে কিংবা টোকেন হিসেবে দয়া করে নারীকে স্থান দেওয়ার জন্য। এই শিক্ষিত নারীদের বিরাট একটা অংশ আবার পৈত্রিক সম্পত্তির সমান অধিকারের দাবিরও বিরোধিতা করে থাকেন। এমনকি যারা এই দাবি তোলেন এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে লড়াই জারি রেখেছেন, তাদের তারা ঘৃণার চোখে দেখেন। রোকেয়া পাশ করা বিদ্যার চেয়ে, প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আমাদের পাশ করা বিদ্যাধরীর অভাব নেই আজ, শুধু যথেষ্ট অভাব রয়েছে প্রকৃত শিক্ষিতের।
তৎকালীন কঠোর অবরোধ প্রথার ভিতরও নিম্নবিত্ত, কৃষাণী, শ্রমজীবী নারীরা উৎপাদনের সাথে তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন এবং ছিলেন অনেকটা স্বাধীন। এই শ্রেণির নারীরা রোকেয়ার এক্টিভিজমের অংশ ছিলেন না। যদিও রোকেয়া তাঁর একাধিক লেখায় ( কূপমণ্ডূকের হিমালয় দর্শন, সুলতানার স্বপ্ন, চাষার দুক্ষু) শ্রমজীবী ভুটিয়ানী নারীদের কঠোর পরিশ্রম ও স্বাধীনচেতার কথা উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ করেছেন, রংপুর অঞ্চলের কৃষক রমণীদের এণ্ডি রেশমের পোকা প্রতিপালন এবং চরকায় সুতা কেটে পোকার গুটি থেকে এণ্ডি কাপড় তৈরির কথা। জোর দিয়েছেন, দেশি শিল্প তথা নারী-শিল্প পুনরুদ্ধারের উপর। এই শ্রেণির নারীরা অতীতের মতো আজও শিক্ষার আলো থেকে অনেকেই বঞ্চিত। রোকেয়া মোটাদাগে মূলত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীদের নিয়ে ভেবেছেন, তাদের মধ্যে কাজ করেছেন। ফলে মনে হতে পারে তখন সব শ্রেণির নারীরাই বুঝি পরাধীন, পরনির্ভর ছিলেন। অবশ্য তখন ভারতবর্ষের শিল্পের বিকাশের সূচনাকাল হওয়ায় শ্রমিক শ্রেণির নারীদের পরিমাণও তেমন একটা হওয়ার কথা না। বিপুল সংখ্যক নারীর প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পের সাথে যুক্ত থাকার পরও এখনকার অধিকাংশ নারীবাদীদের প্রথম ও প্রধান মনোযোগ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীরাই। এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীনতা, নির্মম নির্যাতন ও মৃত্যুর শিকার গার্হস্থ্য সহকারী, ভূমিহীন কৃষাণী ও সমান কাজ করেও কম মজুরি পাওয়া নারী কৃষি শ্রমিকের বঞ্চনা, কারখানায় নারী শ্রমিকের স্বল্প মজুরি, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও অনিরাপদ কর্মপরিবেশ, গৃহিণীর অনিশ্চিত জীবন, নিম্নবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণির নারীদের কোন রকমে বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম ইত্যাদি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীদের সমস্যার আড়ালে নাই হয়ে যায় প্রায়শই।
সমাজের অনগ্রসর, বিপদগ্রস্ত, বৈষম্যের শিকার নারীদের জন্য কাজ করা এবং তাদের সচেতন ও সংগঠিত করা নারীদের সম্পর্কে আদিকালেও নেতিবাচক মনোভাব কাজ করেছে, আজও কাজ করে প্রবলভাবে। অথচ তাদের তিক্ত লড়াইয়ের পরে পাওয়া মিষ্ট ফল ভোগ করতে কিন্তু কেউ পিছপা হয় না! নারী শিক্ষা, নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক কাজে নিয়োজিত থাকায় তারিণী বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী রেজিয়া বানুর শাশুড়ী পরিচালক দীন তারিণী সেনকে বাজে অভিধায় অভিহিত করেছিল। রেজিয়া বানুর কাছ থেকে সে কথা জানার পরও মিসিস তারিণী সেন কোন প্রতিক্রিয়া দেখাননি। শুধু তা-ই না, সৌদামিনীরা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালে তিনি বরং তাদের সান্ত্বনা দেন, ‘তোমরা এত দু:খিত হইতেছ কেন? লোকে ওরূপ বলিয়াই থাকে; ও-সব কথা ধর্ত্তব্য নহে’। “পদ্মরাগ” উপন্যাসের মিসিস তারিণী সেন যেন শত প্রতিকূলতা, অপবাদের শিকার রোকেয়ারই প্রতিচ্ছবি। “নারী অঙ্গন” ( নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি প্লাটফর্ম) এর সাথে আলাপ পরিচয় থাকা কোন মেয়ের প্রেম, বিয়ে ভেঙে গেলেও আমাদের দায়ী করা হয়। প্রচার করা হয়, আমরা বুদ্ধি দিয়েছি এসব করতে। অথচ কার সাথে প্রেম ছিল, কখন বিয়ে ভেঙে গিয়েছে, আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের আগে দেখা গেছে জানতামই না! মিসিস তারিণী সেনের মতো আমরাও তখন মুচকি হাসি এবং মনে মনে বলি ‘লইব, খাইব, গালিও দিব’।
‘আমি কারসিয়ং ও মধুপুর বেড়াইতে গিয়া সুন্দর সুদর্শন পাথর কুড়াইয়াছি ; উড়িষ্যা ও মাদ্রাজে সাগরতীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের বিবিধ আকারের ঝিনুক কুড়াইয়া আনিয়াছি। আর জীবনের ২৫ বৎসর ধরিয়া সমাজসেবা করিয়া কাঠমোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইতেছি’– অবরোধ-বাসিনী” বইয়ের ভূমিকায় রোকেয়ার নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া ছিল এমনই। আজও কাঠমোল্লারা রোকেয়াকে ভয় পায়, অভিসম্পাত করে, তার ভাস্কর্যে কালি মাখিয়ে দেয়, তার নামে নির্মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের খায়েশ দেখায়। যেমন এরা ক্যান্সারের মতো আতংকে ভোগে একালের নারীবাদী, নারী অধিকারকর্মীদের নিয়ে।
রোকেয়ার আমলে ইউরোপ- আমেরিকার মতো তুরস্ক ও মিশরে ছেলে ও মেয়েকে সমভাবে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বাধ্যতামূলক আইন করে। রোকেয়া স্বপ্ন দেখতেন, ভারতবর্ষেও একদিন এমন আইন হবে। রোকেয়ার সেই স্বপ্ন বহু আগেই পূরণ হয়েছে। আমরাও স্বপ্ন দেখি ভারত, তুরস্ক, তিউনিসিয়া ইত্যাদি দেশের মতো এক সময় সব ধর্মের নারী ও পুরুষ সম্পত্তিতে সমান অধিকার পাবে, সব রকম বৈষম্যমূলক আইন বাতিল হবে এবং একটা ইউনিফর্ম পারিবারিক আইন তৈরির মাধ্যমে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে স্বীকার করে নেওয়া হবে নারী ও পুরুষ সমান। কৃষাণী, গৃহিণী, গৃহ পরিচারিকা, শ্রমিক নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। রোকেয়া জানতেন, ‘অবশ্য আমরা ইহার ফল ভোগ করিতে পাইব না- ফল ভোগ করিবে আমাদের তৃতীয় পুরুষ। যে তালের গাছ বপন করে, সে কদাচিৎ ফল খাইতে পায়’!(আশা-জ্যোতি:)এরপরও রোকেয়া আমৃত্যু লড়াই জারি রেখেছিলেন। রোকেয়ার মতো আমরাও আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে যেতে চাই সব রকম ঝড়-ঝঞ্ঝা সত্ত্বেও।