ছাত্র জনতার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন বিবিসি বাংলায় আমরা টেলিভিশনের ভাষায় যাকে ভক্সপপ বলি, সেরকম একটা ভক্সপপ দেখি। একজন অল্পবয়সী মেয়ে, ধারনা করি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হবেন–তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, নারী কোটা তারা চান না। নারীরা যথেষ্ট এগিয়ে গেছেন। ফলে আর কোটার প্রয়োজন নেই। আওয়ামী লীগ নারী কোটা রেখেছিল ১০ ভাগ। পরে অ্যামেন্ডমেন্ড এর পর তা বাতিল করা হয়। শেখ হাসিনা গোস্বা করে সবই বাদ দিতে চেয়েছিলেন। পরে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, “নারীরাই তো কোটা চায় না, তো বিজ্ঞ আদালতের আর কী করার আছে!”
আমার চোখে ভাসে গ্রামের হাজার হাজার স্বল্পশিক্ষিত সেইসব নারীদের কথা, যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে পেয়েছিলেন একটা আপাত সম্মানের জীবন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা- ২০১৯’ অনুযায়ী ৬০ শতাংশ নারী এবং ২০ শতাংশ পোষ্য কোটা সংরক্ষিত রাখা হয়। বাকি ২০ শতাংশ পদে পুরুষ নিয়োগ পেতেন। গ্রামে-গঞ্জে দেখবেন টাইট করে শাড়ি পরা নারীরা কি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পথ হাঁটতেন এই এক চাকরির জোরে।
এদিকে শেখ হাসিনা রাগ করেন, কোর্ট ঢাকার রাজু ভাস্কর্যে শ্লোগান দেওয়া নারীটির কথা শোনেন। যে ২০ ভাগ পুরুষ শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তারা দাঁত কিড়মিড় করেন। আর এসব কিছুর মধ্য দিয়ে নারীর প্রতি একটি রাষ্ট্রের ল্যাজেগোবরে অবস্থার চিত্রটি স্পষ্ট হয়। কেউ বলে দিয়ে যায় না নারীকে অধিকারসম্পন্ন করতে কারও রাগ-অনুরাগ, কারও অনলবর্ষী শ্লোগান, কারও দ্বেষ জরুরি নয়, কল্যাণ রাষ্ট্রের এটা দাায়িত্ব।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর এক একটি করে মাথার ভেতর হ্যামারিং করা দৃশ্য আমি অন্তত দেখতে পাই। আন্দোলনে নারীদের ছবি ব্যবহার করে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া আবেগের নারীগুলোর দেখা আর কোথাও পাওয়া যায় না। তারা কোথায় যেন হারিয়ে যান। এ নিয়ে আমার মতো দুই চারজন অর্বাচীন প্রশ্ন তুলতে থাকলে খুব কৌতুকপ্রদভাবে দৃশ্য পাল্টাতে থাকে। বেশিরভাগ সভা সেমিনার সমাবেশে নারীর ছায়াও আর দেখা যায় না। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক সভা সেমিনারে সামিনা লুৎফা, গীতি আরা নাসরীন ছাড়া আর কাউকে দেখা যায় না।
এই টোকেনিজমটাই কৌতুককর লাগতে থাকে আমার কাছে। টোকেনিজম কী? কিছু করার অভ্যাস (যেমন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর একজন ব্যক্তিকে নিয়োগ করা) শুধুমাত্র সমালোচনা প্রতিরোধ করতে এবং এমন চেহারা দিতে যে মানুষের সাথে ন্যায্য আচরণ করা হচ্ছে –তাকেই টোকেনিজম বলে।
আলোচনায় একথাও আসে যে, নারীরা যদি যথেষ্ট যোগ্য না হোন তাহলেও কেন তাদের ডাকতে হবে? অথচ সর্বব্যাপী আন্দোলনে নারীর যোগ্যতার প্রশ্ন আসেনি, তখন নারী নিজেই যোগ্য হয়ে গেছেন বিধায় কোটা চান না বলে বলেছিলেন।
এখন এই টোকেনিজম কেন? কেন সব জায়গায় কোন রকমে মুখরক্ষার জন্য নারীর একটা অবয়ব দেখিয়েই খুশি থাকতে বলা হচ্ছে? পূর্ণাঙ্গভাবে ঘোষিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের মোট সদস্য ৫০ জন। এর মধ্যে সাবেক আমলা ১৫ জন, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ২ জন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ৮ জন, বিচারপতি ও বিচারক ৫ জন, আইনজীবী ৬ জন, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ৬ জন এবং অন্যান্য পেশার (এনজিও, মানবাধিকারকর্মী, বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি) ৮ জন। এসব পেশাজীবীর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫ জন মাত্র। ১০টি কমিশনের প্রধান পদের মধ্যে নারী স্থান পেয়েছেন মাত্র ১ জন, তা-ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনে। যে বৈষম্য বিলোপ চেয়ে এতোগুলো মানুষ প্রাণ দিল সেখানে নারীর প্রশ্ন, নারীর জীবন, নারীর চাওয়া-পাওয়া কতটা প্রতিফলিত হলো?
গত বছর ৩ অক্টোবর প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেছিলেন, “এই আন্দোলনে মেয়েদের সম্পৃক্ততা ছিল বিরাট। এখন অনেকে ভুলে গেলেও এ কথাটা সত্য যে মেয়েরা না থাকলে এই আন্দোলন কোনভাবেই সফল হতো না।” আমি তাকে আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম এই সত্য তুলে ধরার জন্য। কিন্তু আর দশজন আন্দোলনকারীর মতো মেয়েরাও যে আদর্শগতভাবে সাহসের সঙ্গে ফ্যাসিবাদী নিপীড়নের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিল, এই ন্যারেটিভে কেন যেন তা অনুপস্থিত।
টোকেনিজম আমার কাছে তাই একটা অন্যায়ের নাম যা দিয়ে আসল সত্যকে ধামাচাপা দেওয়া হয়, আসল কন্ঠস্বরকে রুদ্ধ করা হয়, আসল বাস্তবতাকে অদৃশ্য করা হয়। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা সমাবেশে বক্তব্য দেয়া একজন নারী দিয়েই সবার কথা বলা হয় না।
রাষ্ট্র সংস্কার হচ্ছে। এখন নারীদের ভাবতে হবে সংস্কারের পর তারা কি আর জায়গা পাবেন? রাষ্ট্র সংস্কারের পর জনসংখ্যার অর্ধেক জুড়ে থাকা এই অদৃশ্য নারীরা কি ভবিষ্যতে দৃশ্যমান হবেন? না কি এখনই, এই সংস্কারের সময়ই তারা তাদের কন্ঠস্বরটি জোরালো করবেন, জোরালো করবেন (সম্মিলিত করবেন) যেন তারা কিছুতেই ইনভিজিবল একটা জনগোষ্ঠী না হয়ে যান।
ভাবার সময় বয়ে যায়।