স্মার্টফোন হাতে আসবার পর আর ওয়াই-ফাই সহজলভ্য হয়ে যাওয়াতে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার ব্যাপারটা ডাল-ভাতের চেয়ে সহজ হয়ে গিয়েছে। বাসে যেতে যেতে, ডাক্তারের চেম্বারে বসে অপেক্ষা করতে করতে, এমনকি মলমূত্র ত্যাগ করতে কমোডে বসে বসে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া যায়। তাই অনেক ব্যস্ত আর দায়িত্বশীল মানুষকেও দেখবেন, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন, মিম শেয়ার করছেন। কারণ এতে বাড়তি কোন এফোর্ট বা সময় খরচ করতে হয় না। আমি নিজেও ফেসবুকে প্রতিদিন বহু ছবি, মিম এবং মতামত পোস্ট করে থাকি। কিন্তু ‘নারী কীসে আটকায়?’ এই প্রশ্নটা এতো বেশি অবান্তর যে, এ নিয়ে কোন কিছুই আমি লিখিনি। শুধু নিউজফিড দেখে বিরক্ত হয়ে এড়িয়ে গিয়েছি।
এই প্রশ্নটিকে অবান্তর কেন বলছি, এক এক করে বলি।
প্রথমত, প্রশ্নটি করা হয়েছে বিদেশের কিছু নামজাদা পুরুষের বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া নিয়ে। হৃত্বিক রোশান, জাস্টিন ট্রুডো এবং আরো দুই-একজন সুদর্শন, অর্থ, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিওয়ালা পুরুষের বিবাহ বিচ্ছেদের খবরে বিস্মিত হয়ে এক মূর্খ এই প্রশ্ন করেছে আর সমগ্র জাতি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে লেগে গেছে! এই প্রশ্নের মূলে আছে নারীর প্রতি অপমানকর এক ধারণা যে, নারী আসলে পুরুষের অর্থ, ক্ষমতা, রূপ, কিংবা খ্যাতির জন্য তাকে বিয়ে করে তার ধর্মপত্নী হিসেবে তার সাথে থাকে। এটি অত্যন্ত আপত্তিকর একটি ভাবনা।
হ্যাঁ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষকেই যেহেতু পরিবারের প্রতিপালক হিসেবে দেখা হয় এবং ব্রেড উইনার কিংবা ভরণ-পোষণকারীর ভূমিকায় পুরুষই থাকেন, তাই পরিবার থেকে বিয়ে দেওয়া হলে পাত্রের আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে কি না, বউকে ভালো মতন রাখতে পারবে কি না, তা দেখা হয়। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, উপার্জনক্ষম পুরুষের জন্য বিবাহ করা ফরজ। কিন্তু যে স্ত্রীকে তার প্রাপ্য দিতে পারবেন না, তার জন্য বিয়ে করা হারাম। সেই হিসেবে একটি মেয়ে যৌবনের উদ্গম হলেই বিবাহযোগ্যা। কিন্তু একটি ছেলে রোজগার না করলে বিবাহযোগ্য নয়। ভালো রোজগারের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চাওয়া বাবা-মায়ের জন্য স্বাভাবিক। মেয়ে যদি মনে করেন, তিনি নিজে কোন কেরিয়ার গ্রহণ করবেন না, সংসার ও সন্তান পালন করেই জীবন কাটিয়ে দেবেন, তাহলে তার জন্যও উপার্জনক্ষম জীবনসঙ্গী খোঁজা স্বাভাবিক। তার মানে এই নয় যে, মেয়েরা শুধু টাকাওয়ালা দেখেই বিয়ে করেন। আর টাকা থাকলে সেই পুরুষের সঙ্গে মনের মিল বা সুস্থ যৌনসম্পর্ক না হলেও চলবে। কিংবা এমনও না যে, নারীরা শুধু সেক্স এপিল দেখেই সঙ্গী বেছে নেন, অর্গাজম পেলে সেই পুরুষ ধরে পেটালেও তার পায়ের তলে থেকে যাবেন।
একই কথা পুরুষদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নিকোল কিডম্যানের মতন কিংবা এঞ্জেলিনা জোলির মতন লাখো পুরুষের স্বপ্নের নারীদেরও বিয়ে ভেঙে যেতে পারে। সব দিক থেকে না মিললে শুধু সৌন্দর্য আর যৌন আবেদনের জন্য কোন পুরুষ নিশ্চয়ই সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে অসুখী দাম্পত্য টেনে নেবেন না। যেহেতু প্রশ্নটা নারীদের নিয়ে করা হয়েছে, তাই পুরুষের প্রসঙ্গ বাড়াচ্ছি না। যদিও আমি বিশ্বাস করি, এই অর্থ-সৌন্দর্য-যৌন আবেদনের বেড়াজালে আটকে না থাকা পুরুষের সংখ্যাও কম নয়। মনের মিল, যৌথ জীবনে ঠিকঠাক আন্ডারস্ট্যান্ডিং না হলে আপোসেও সংসার ভেঙে যেতে পারে। এখানে ‘ভেঙে গেল’ না ভেবে তারা যেমন নিজ সিদ্ধান্তে একত্র হয়েছিলেন, তেমনি নিজ সিদ্ধান্তে বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন ধরে নেওয়াটাই পরিণত চিন্তার লক্ষণ।
দ্বিতীয়ত, প্রশ্নটি করা হয়েছে বিদেশের কিছু উদাহরণ দিয়ে। আমাদের সমাজে নারী নিজে থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ নিতে চান এমন পরিস্থিতি সম্প্রতি উদ্ভূত হয়েছে কিংবা হচ্ছে। আমাদের আগের জেনারেশনের অনেক নারী বাধ্য হয়ে আটকে থাকতেন। স্বামী মারধর করেন, অন্য নারীতে আসক্ত, যৌনসুখ দিতে পারেন না, পঙ্গু, নেশা করেন কিংবা অপরাধী, দুর্নীতিগ্রস্ত— এসব জেনে আর মেনে বহু নারী সেই স্বামীর ঘর করে যাচ্ছেন, এমন ঘটনা কি আপনারা দেখেননি? না দেখলে বলতে হবে, আপনারা অন্ধ। আর দেখেও এর কারণ না বুঝলে বলতে হবে, আপনারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। পুরুষের সকল অন্যায়-অনাচার-নির্যাতন মুখ বুজে মেনে নিয়ে মেয়েরা স্বামীর ঘরে আটকে আছে, কারণ তাদের আর উপায় নেই। বাপের বাড়িতে বাপ-ভাইয়ের বোঝা হয়ে থাকতে হবে বলে, সন্তানদের নিয়ে টানাহেঁচড়া হবে বলে, সামাজিকভাবে অসম্মানের মুখোমুখি হতে হবে বলে, ভবিষ্যতে মেয়ের বিয়ে দিতে সমস্যা হবে বলে অসংখ্য নারী অসুখী বৈবাহিক সম্পর্কে আটকে আছেন। কাজেই বাংলাদেশের কনটেক্সটে এরচেয়ে অবান্তর প্রশ্ন আর নাই।
সম্প্রতি আমার পরিচিত মহলে দুটি এমন ঘটনা ঘটেছে। মেয়ের আগের সম্পর্ক জেনে গিয়ে বিবাহের কয়েক মাসের মধ্যে বর তালাকের নোটিস পাঠিয়েছেন। মেয়ের চৌদ্দ গুষ্টি বর এবং বরের চৌদ্দ গুষ্টির হাতে-পায়ে ধরে সেই তালাক ঠেকিয়েছে। দ্বিতীয় ঘটনাটি বিয়ের এক বছর পরের। ততদিনে একটি শিশুর জন্ম হয়ে গেছে। মেয়ের পূর্বপ্রেমিক মেয়ের আগেই বিবাহিত, সেই সম্পর্ক চুকে-বুকে গেছে বহুদিন আগে। তবুও শিশু সন্তানসহ মেয়েকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন গুণধর, সুদর্শন, উপার্জনক্ষম বর। কেননা বাংলাদেশে ‘ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার মরে গরু’।
যেহেতু সৃষ্টিকর্তা তাদের ততো সৌভাগ্য দেননি, বউ মরে যায়নি, তাই কৃত্রিমভাবে তারা সেই সৌভাগ্য তৈরি করে নিলেন।
এই দুই হাজার বিশ-একুশ-বাইশ-তেইশ সালেও যদি কেউ আশা করে, ২৫/২৬/২৭ বছরের মেয়ের জীবনে কোন প্রেম আসবে না, বিবাহের আগে মেয়েদের অনাঘ্রাতা পুষ্প হয়ে মধুমক্ষী পতি দেবতার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তারা বিয়ের আগে খোঁজ-খবর করলেন না কেন? মেয়ের পাড়ায় বা কলেজে খোঁজ নিলেই তো জানা যায়, আগে সে কারো সঙ্গে মিশত কি না। ফেসবুকের পেইজ স্ক্রল করলে মেয়ের জীবনযাপন সম্পর্কে জানা যায়। তা না করে বিয়ের পর শেইমিং করার মানে কী?
কিছুদিন আগে আরেক আত্মীয়মহলে এমন ঘটনা দেখেছি। বউয়ের কোন প্রাক্তন প্রেমিক ছিল না। তবে বউয়ের ‘দোষ’, সে মোটা। বিয়ের সময়ও সে মোটাই ছিল। সঙ্গে তার বাবার বাড়ি থেকে আসা মোটা উপহার, ফ্রিজ, টিভি, ফার্নিচার ছিল। ফিরে আসার সময় অবশ্য মেয়েটি মোটা দেহটি নিয়েই ফিরে এসেছে। সঙ্গে মেয়ের বাপের দেওয়া বিদেশি ব্র্যান্ডের ঘড়িটি কিন্তু হাত থেকে খুলে দেয়নি বর। তালাকের কিছুদিন পরেই ছেলে আবার বিয়ে করল। মেয়েটি কিন্তু অবিবাহিতই রয়ে গেছে। আর বিয়ে করবে না, শখ মিটে গেছে জানিয়ে নিজের মতন চাকরি-বাকরি করছে, ছোটবোনের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অনুমান করি, সেই বর দ্বিতীয় বউয়ের বাপ-মায়ের কাছ থেকেও এমন মোটা উপহার পেয়েছে। এ-ও অনুমান করি যে, বউয়ের স্থূলত্ব নিয়ে অসুখী সেই বর বউকে জিমে ভর্তি হতে উৎসাহ না দিয়ে গোপনে সেই দ্বিতীয়ার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করছিলেন। নইলে এত দ্রুত আরেক সম্বন্ধ হয় কী করে?
চিত্রনায়ক শাকিব খান ছাড়াও এমন আরো অনেক বাংলাদেশি পুরুষের উদাহরণ দিতে পারবো, যারা সামান্য বিচ্যুতি কিংবা কোন রকম বিচ্যুতি ছাড়াই বৈবাহিক সম্পর্কে আটকে থাকেননি। খুঁজে নিয়েছেন দ্বিতীয় বা তৃতীয় কাউকে। অপরপক্ষে, স্বামীর সকল স্খলন-পতন সহ্য করে নিরুপায় হয়ে আটকে আছেন অনেক নারী। যদিও বুবলি কিংবা অপু বিশ্বাসকে আমি সেই দলের বলে মনে করি না। উনাদের আটকে থাকতে চাইবার কারণ সম্ভবত আত্মবিশ্বাসের অভাব।
এই অত্যন্ত বিরক্তিকর, বোকা বোকা প্রশ্নের, ভাইরাল প্রশ্নের জবাবে এতগুলি কথা কেন লিখলাম? কারণ জাতির মূর্খতায় আমি বিরক্ত। আমি নিজে একজন স্বাবলম্বী নারী। লেকচারার হিসেবে আমার প্রথম কর্মস্থলে যোগদান করার কয়েক মাসের মধ্যেই সহকর্মীদের কাছ থেকে আমার শুনতে হয়েছে, আমি কেন ডিভোর্সি? আমি বলেছি, “বনিবনা হচ্ছিল না, তাই।” সম্ভবত এই উত্তরে তারা সন্তুষ্ট হননি। তারা আরো রসালো কারণ অনুমান করে নিয়েছিলেন হয়তো। ধরে নিলাম, আমার বা অন্য যে কারো বিবাহে বনিবনা না হবার কারণ ছিল হয় স্বামীর লাম্পট্য কিংবা স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতা কিংবা যে কোন একজনের যৌন অক্ষমতা, যে কোন একজনের এবিউসিভ আচরণ কিংবা মানসিক সমস্যা অথবা যে কোন একজনের পরিবারের মানুষের অসহযোগিতা। কারণ যা-ই হোক, নতুন পরিচিত একজনকে কেউ এসব অত্যন্ত ব্যক্তিগত আর পারিবারিক ব্যাপার বলবে কেন? আশাই করে কেন লোকে যে, একসঙ্গে থাকবার কিংবা আলাদা হয়ে যাবার কারণ কেউ তাকে বলবে?
এই প্রশ্নগুলো অত্যন্ত অশ্লীল এবং অরুচিকর। জাতি হিসেবে আমরা যে মূর্খ এবং বোধবুদ্ধিহীন, তা আরেকবার প্রমাণিত হলো এই প্রশ্ন ভাইরাল হবার মাধ্যমে। এই দুই হাজার তেইশেও যখন তালাক ঠেকানোর জন্য মেয়ের বাপের বাড়ি থেকে বিয়ের সময় ফ্রিজ, টিভি, ওয়াশিং মেশিন, ওভেন দেওয়াই যথেষ্ট হচ্ছে না, ছেলের বাড়িতে প্রতি কুরবানি ঈদে আস্ত গরুর রান আর প্রতি গ্রীষ্মে আম-কাঁঠাল-লিচু পাঠিয়ে তুষ্ট করতে হয়, তখন প্রশ্নটা উল্টা হওয়া উচিৎ, পুরুষ আটকে থাকে কীসে? অপু বিশ্বাসের আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিয়ে ছেলে নিয়ে জাতির সামনে নাকের পানি, চোখের পানি করাও তো আটকাতে পারলো না শাকিব খানকে। মেয়ের বাপের দেওয়া ঘর ভরতি ফার্নিচার আর ব্র্যান্ডের ঘড়ি আর দামি স্যুট আটকাতে পারেনি বহু তথাকথিত সুপাত্রকে। আটকাতে চাওয়ার চিন্তাটাই হাস্যকর আর বিশেষত নারীকে আটকাতে চাওয়ার ইচ্ছাটা পুরুষতান্ত্রিক এবং নারীর জন্য অসম্মানের বলে মনে করি।