শনিবার, জুলাই ২৭, ২০২৪
Homeদিদিমণিদের রোজনামচাঅর্থনীতির চাকা সচল রাখা আরিফা বেগমরা কেমন আছে

অর্থনীতির চাকা সচল রাখা আরিফা বেগমরা কেমন আছে

৩০ বছরের আরিফা বেগমের বাড়ি নওগাঁ জেলার কোনো এক গ্রামে। কাজ করছেন আশুলিয়ার এক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, বিগত ৮ বছর ধরে এখানেই কাজ করছেন তিনি।

“৮ বছর তো আসলে বেশ অনেকটা সময়। এতদিন!”
“হ্যাঁ, সময়ের হিসাব করলে তাই-ই। অথচ মনে হয় সেদিনের কথা। কিন্তু এতবছর চাকরিই করছি আসলে। তেমন টাকা পয়সা আর জমে নাই। জমানোর ইচ্ছা থাকলেও বাজারের যা অবস্থা! যা বেতন পাই, তা দিয়ে কুলানো মুশকিল।”

৯ বছরের একটা মেয়ে আছে তার, যে একটা লোকাল স্কুলে পড়ছে, ক্লাস ফোরে। আরিফার স্বামীও পাশেই আরেক ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন।

কথায় কথায় জানলাম, আরিফা প্রথম বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় এসেছিলেন ২০১০ সালে। তখন তিনি সবে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। খুব তালেবর কিছু হবেন, তা না ভাবলেও গার্মেন্টসে কাজ করতে হবে, ভাবেননি কোনদিন। কিন্তু পরিস্থিতি এমনই ছিল। বাবার ঋণ শোধ করা এবং তার ভাষ্যমতে ভাই না থাকায় সংসারের হাল ধরতে চলে আসতে হয় ঢাকায়। আর কে না জানে, গার্মেন্টসে গেলেই কাজ পাওয়া যায়।

কিংবা আরিফা বেগমকে যদি সেদিন পড়াশোনা ছাড়তে না হত, তাহলে… তাহলে তার জীবনটা আজকে অন্যরকম হতে পারত কি না? কিংবা, এখানে আমাদের বা মোটাদাগে সমাজ বা রাষ্ট্র যাকে বলছি, তার কোন দায় তৈরি হয় কি না?

আলাপ এগিয়ে চলে…

যাই হউক, আরিফাও একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েই ফেললেন। চলে এলেন। একটা ফ্যাক্টরিতে কাজও পেয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে বাবার ঋণ শোধ হলো। ধন্যি মেয়ের তকমা না জুটলেও ‘যারা গার্মেন্টসে কাজ করে, তারা যে কেমন মেয়েমানুষ’ এই তকমা জুটেছিল।

দেশের অর্থনীতি এই একটা খাতের উপরই বহুলাংশে নির্ভরশীল। সেখানকার প্রধান চালিকাশক্তি আবার নারী, যারা কি না তথাকথিত ভদ্র সমাজে ব্রাত্য। একটা দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কেন মনে হবে যে, গার্মেন্টসে কাজ করে মানেই সে একজন খারাপ মেয়েমানুষ? এখানে খারাপের সংজ্ঞাটা আসলে কী দাঁড়াচ্ছে?

বছর দুই আগে আরেক নারী শ্রমিকের সাথে কথা হচ্ছিল। যিনি ছিলেন ডিভোর্সি এবং সিঙ্গেল মাদার। এ-ও জানিয়েছিলেন, তার আত্মীয়-পরিজন এবং সকল পরিচিত মানুষ তার জীবিকার উৎস হিসেবে গার্মেন্টসকে মেনে নিতে পারেননি। অথচ চাকরি করার আগে সন্তান নিয়ে চরম অর্থকষ্টে থাকলেও তার এই শুভাকাঙ্ক্ষীদেরকে পাশে পাওয়া যায়নি।

আলাপের এক পর্যায়ে জানা গেল, ঋণ শোধ হবার পর আরিফা কাজ ছেড়ে দিয়ে ফিরে যান।

বিয়ে করে আবার ২০১৩ সালে ফেরত আসেন। তখন দেখেন, বাপের ঋণ শোধ হলেও সংসার চলে না। আবার একই অবস্থা। বাপকে বিভিন্ন এনজিও-সমিতির লোনের হাত থেকে বাঁচাতে আরিফা আবার চাকরি শুরু করলেন। স্বামী শুরুতে বাধা দিলেও পরে মেনে নেয়। আরিফা দেখে, তার নিজের টাকার উপর তার কোনো অধিকার নাই। বেতন তুলে এনে স্বামীর হাতে দিয়ে দেন। বলা যায়, দিতে হয়। দিতে বাধ্য হোন। বেতনের টাকা থেকে কৌশলে কিছু টাকা সরিয়ে বাবাকে পাঠিয়ে দেন। এক পর্যায়ে ডিজিটালাইজেশনের ফলে নিজের টাকা নিজে চুরি করার রাস্তাও বন্ধ হয়ে যায়। এবার দেয়ালে পিঠ ঠেকে। আরিফা তার স্বামীকে জানান, একাউন্টের পিন নাম্বার আর তার স্বামীর কাছে থাকবে না। এখানে সফল হতে তাকে যা করতে হয়, তা প্রায় একটা মহাকাব্য। শারীরিক, মানসিক— কোন ধরনের নির্যাতনই বাদ যায়নি। তবে দিনশেষে আরিফা বেগমই সফল হোন।

“এখন কেমন আছেন?”
প্রশ্নের জবাবে জানান তিনি, অনেক ভালো আছেন৷ মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে, বাবা-মা ভালো আছেন।
“আর আপনি?”

এই প্রশ্নের কোন সোজা উত্তর অবশ্য আরিফা দেননি বা দিতে পারেননি। একটু হকচকিয়ে গিয়েই নিজেকে সামলে নিলেন। জানালেন, কাকভোরে উঠে রান্না করতে হয় স্বামী, মেয়ে এবং নিজের জন্য। তারপর সব কাজ শেষ করে ফ্যাক্টরি। এরপর সন্ধ্যায় ফিরে সব কাজ, রান্নাবান্না করে পরের দিনের কাজ এগিয়ে তারপর ঘুমাতে যাওয়া। পরদিন আবার ফজরের ওয়াক্তে ওঠা।

“এরমধ্যে আসলে ভালো আছেন?”
“মেয়েমানুষের তো এই জীবন। নিজের বলতে তো সংসারই। তাদের জন্যই তো আমি৷ স্বামী তো আর ঘরের কাজ করবে না। পুরুষ মানুষ।”

এই যে, একটা মানুষ যে ভালো নেই, তা সে জানেও না। কিংবা এই যে একটা ‘মেয়েমানুষের জীবন’ তকমা পাওয়া একটা জীবন, সেটা আসলে কেমন?

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাম্প্রতিকা