শনিবার, জুলাই ২৭, ২০২৪
Homeআইন ও নারীউত্তরাধিকার আইন : নারীকে সেলফহীন করে রাখার সবচেয়ে কার্যকর পিতৃতান্ত্রিক হাতিয়ার

উত্তরাধিকার আইন : নারীকে সেলফহীন করে রাখার সবচেয়ে কার্যকর পিতৃতান্ত্রিক হাতিয়ার

বাংলাদেশে হিন্দু নারীদের পিতার সম্পত্তিতে পুরুষের মতো সমান ভাগ চেয়ে আদালতে একটা রিট হয়েছে সম্ভবত গত মে মাসে। হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা অংশ এই রিটের বিরোধিতা করেছে। বিরোধীদের দোহাই, ‘ধর্মান্তর বাড়বে, বোনকে যে সম্পত্তি দিবে, স্ত্রী-ও একই সম্পত্তি বাপের বাড়ি থেকে পাবে, তাই নারীর সম্পত্তির দরকার নাই’— এই রকম! এইখানে প্রথম যুক্তির ত্রুটি হলো, মানুষের ধর্মান্তরিত হওয়ার স্বাভাবিক রাইটকে অস্বীকার করা হচ্ছে। পরের যুক্তিটাতে নারীর স্বতন্ত্র সত্তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। আমি বহুদিন ধরেই পিতৃতন্ত্রের আগ্ৰাসনে সৃষ্ট নারীর সংকটকে প্রধানত নারীর সেলফহীনতা এবং অর্থহীনতার সংকট বলে বলে আসছিলাম। এই রিটের প্রতিক্রিয়াগুলোতে এটা আরো স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল।

পিতৃতন্ত্রের কাছে নারীর একক কোন সেলফ নেই। ধর্ম ও সংস্কৃতি ভেদে কোথাও এই সেলফ হয়ে উঠেছে অর্ধ, আবার কোথাও একেবারেই শূন্য। নারীর এই অর্ধ-সেলফ বা সেলফহীনতার বাস্তবিক নজিরই সবচেয়ে বেশি মূর্ত হয়ে উঠেছে উত্তরাধিকার আইনে। একজন পুরুষ বাপের সম্পত্তি পাচ্ছে, একজন নারী পাচ্ছে না। কেন পাচ্ছে না? কারণ তো শুধু এটাই হতে পারে, নারীর কোন সেলফ নেই। নারীর যা আছে, তা পুরুষেরই অন্তর্ভুক্ত! নইলে ‘বোনকে যে সম্পত্তি দিবে স্ত্রীও একই সম্পত্তি পাবে’— এই ধরনের লজিক সামনে আসতো না। এই লজিককে উল্টিয়েও আলাপ পারা যায়। বোনকে যে সম্পত্তি দিবে, স্ত্রী তো সে সম্পত্তি আনবেই। তাহলে বোনকে দিতে আপত্তি কীসের? হা হা! এখানেও আপত্তি আসবে! আপত্তির মূল কারণ হলো, নারীকে অর্থহীন করে রাখার আকাঙ্ক্ষা। অর্থহীন নারীকে অনুগত এবং বন্দী করে রাখা যায়। তখন জুলুম করলেও মেনে নেয়। কারণ ছেড়ে যাওয়ার পথ থাকে না। কিন্তু যে নারী স্বনির্ভর, নিজের খরচ নিজে চালাতে পারে, তাকে অনুগত দাস করে রাখা কঠিন। জুলুম করেও আটকে রাখা সম্ভব না। স্বনির্ভর নারী বন্দিত্ব ও জুলুম থেকে বেরিয়ে আসবেই।

সুতরাং উত্তরাধিকার আইনে নারীকে পুরুষের মতো সম্পত্তির ভাগ দিতে না চাওয়া শুধু সম্পত্তি দিতে না চাওয়া না। মূলত নারীর স্বতন্ত্র সত্তা এবং স্বনির্ভর হতে দিতে না চাওয়া। বদলে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে নারীকে অনুগত দাস করে রাখার রাষ্ট্র-সমাজে চলমান প্রাচীন সফল আইনটারই ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রচেষ্টা।

রিট বিরোধিতার পোস্টগুলোতে বাঙালি মুসলমানের বিশাল একটা অংশের হাস্যরস করতে দেখা গেছে। তারা যুক্তি দিয়েছেন, ভারতেই তো হিন্দু নারী-পুরুষ সমান উত্তরাধিকার পায়। তাদের দাবিও বাঙালি হিন্দু নারীর অধিকারের পক্ষে। এই অবস্থান আমারও। আমার দর্শন বলে, শুধু মানুষ হওয়ার কারণেই প্রত্যেক সন্তান প্রত্যেক পিতা-মাতার সম্পত্তিতে সমান অধিকার ডিজার্ভ করে। ধর্ম যা-ই হোক! পিতা-মাতার কাছে সন্তানের হক্বও তো এটাই। পিতা-মাতা সব সন্তানকে সমানভাবে দেখবে।

দ্বিচারিতা হলো, যেই বাঙালি মুসলমান হিন্দু নারীর পিতার সম্পত্তিতে পুরুষের মতো সমান অধিকারের দাবিতে সমর্থন দিয়েছেন এবং হিন্দুদের মধ্যে বিরোধী পক্ষকে নিয়ে হাস্যরস করছেন, তাদের বিশাল একটা অংশ নিজের ধর্মের নারীদের পুরুষের মতো সমান সম্পত্তির অধিকার দিতে চায় না। এমনকি ধর্ম যতটুকু অধিকার দিয়েছে নারীকে, ততটুকু থেকেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বঞ্চিত করে! মানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হিন্দু নারীদের ন্যায়োচিত এই দাবির প্রতি বাংলাদেশের মুসলমানের বিরাট এই অংশটার সমর্থন ন্যায়োচিত কারণে নয়। বরং ধর্মীয় বিভেদগত কারণে। এইটাও নোকতা দেওয়ার মতো!

আমরা বাংলাদেশের হিন্দু নারীর মতোই মুসলিম নারীরও পিতার সম্পত্তিতে সমান অধিকার চাই। চাই অন্যান্য ধর্মের অনুসারী নারীদের জন্যও। এই চাওয়া আমার ধর্মের কাছে নয়, রাষ্ট্রের কাছে। রাষ্ট্রে যেহেতু নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য অসাংবিধানিক। যেহেতু রাষ্ট্রে নাগরিক হিসেবেও নারী পুরুষের পার্থক্য নেই। অন্তত আইনে-সংবিধানে হলেও নারী-পুরুষের অধিকার সমান।

তবে ধর্মকেও আমরা বিবেচনার বাইরে রেখে এগিয়ে যেতে চাই না। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের ধর্মীয় মর্যাদা সমুন্নত থাকবে, এইটাই কাম্য। এই কারণে আমরা উত্তরাধিকার আইনে পিতা-মাতার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের (ছেলে-মেয়ে) সমান ভাগের পাশাপাশি রাষ্ট্রে ধর্মীয় উত্তরাধিকার আইনেরও সহাবস্থান চাই। নারী কোন আইনের উপর ভিত্তি করে সম্পত্তির অধিকার নিবে, এইটা ঠিক করবে একমাত্র নারী। ইচ্ছে হলে রাষ্ট্রের, ইচ্ছে হলে ধর্মের বিধান মেনে। এই ব্যাপারে অন্য কেউ হস্তক্ষেপ যেন না করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে! একটা স্যেকুলার রাষ্ট্রে এইটাই হবে কল্যাণকর। দুই পক্ষের পরস্পরের প্রতি উদারতাও দেখানো হবে!

যে নারীরা নারী-পুরুষের সমান উত্তরাধিকারের ন্যায়োচিত দাবি তুলেছেন, তারা যেমন ইনসাফ পাবেন, তেমনি যেই নারীরা ধর্মীয় আইনকে প্রাধান্য দিয়ে সম্পত্তির হিস্যা নিতে চাইবেন, তারাও ইনসাফ পাবেন।

এই চিন্তা ফেসবুকে প্রকাশ করার পর কেউ কেউ এ নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। উনারাও কিন্তু নারী-পুরুষের সমান উত্তরাধিকারের দাবিতে একমত। উনাদের আপত্তিটা ছিল, এক দেশে দুই আইন। এইটা নাকি বেখাপ্পা লাগে। উনাদের অবগতির জন্য বলছি, বাংলাদেশে বর্তমানেও একাধিক উত্তরাধিকার আইন বিদ্যমান। মুসলিম উত্তরাধিকার আইন, হিন্দু উত্তরাধিকার আইন, খ্রিস্টান উত্তরাধিকার আইন ইত্যাদি।

মূলত উনাদের আপত্তিটা ছিল ভিন্ন জায়গায়। রাষ্ট্রে নারী-পুরুষের সমান উত্তরাধিকার আইন কায়েম হওয়ার পরও নারীদের একটা অংশ ধর্মীয় বিধি মোতাবেক সম্পত্তির ভাগ নিবে, এইটা মানতে না পারা। এইটা সামাজিক অসহনশীলতাও, যা বর্তমানে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় করছে। তারা সমান অংশীদারিত্বে বিশ্বাসী এবং দাবিদারদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে প্রতিরোধ করছে। যে কোন ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সহনশীলতা এবং উদার হইতে পারার দরকার আছে, বিপরীত আইডিওলজির প্রতিও। এগুলোই মূলত আন্দোলন সফল করে। সমাজে সহনশীল সহাবস্থানও নিশ্চিত করে।

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাম্প্রতিকা