চার্টার্ড একাউন্টেন্সি পড়তে গিয়ে স্মার্ট শব্দের ইলাবোরেশন সম্পর্কে আমার প্রথম ধারণা জন্মে। আমাদের শিক্ষক এবং সিনিয়ররা সবর্দা স্মার্ট হওয়ার প্রেরণা দিতেন।
এখানে,
SMART-এর
S for Specific
M for Measures
A for Attainable
R for Relevant
T for Time Bound
অর্থাৎ
লক্ষ্য হতে হবে সুনির্দিষ্ট,
লক্ষ্যের থাকতে হবে পরিমাপযোগ্য আউটকাম,
লক্ষ্যের থাকতে হবে বাস্তবসম্মত অর্জনযোগ্যতা,
লক্ষ্য হতে হবে প্রাসঙ্গিক এবং
লক্ষ্যের থাকবে টাইমলাইন।
এই বিষয়গুলো আবার মনে পড়লো। কারণ বাংলাদেশ এখন স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১ প্রকল্প নিয়েছে।
এই স্মার্ট বাংলাদেশের ভিত্তি ৪ টি।
১. স্মার্ট সিটিজেন
২. স্মার্ট গভর্নমেন্ট
৩. স্মার্ট ইকোনমি
৪. স্মার্ট সোসাইটি
এই স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট সোসাইটিতে নারীর অবস্থান কোথায়?
উত্তরাধিকার আইনে এখনো সনাতন ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের কন্যাদের পিতার সম্পত্তিতে কোন হিস্যা নেই স্বাভাবিক পন্থায়। এখনো উত্তরাধিকারের বেলায় মুসলিম পারিবারিক আইনে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার অর্ধেক। আইনগত দিক হতে মুসলিম মেয়েরা কাগজপত্রে যেসব অধিকার পেয়ে থাকেন, সামাজিকভাবে দুর্বল হবার কারণে ততটুকুও তারা বাস্তবায়ন করতে পারেন না।
২০৪১ সালের মধ্যে দেশে কর্মক্ষেত্রসহ সব অবস্থানে নারী-পুরুষের সমতার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবারের বাজেটে। এজন্য নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য কমাতে চলতি বাজেটে ‘জেন্ডার বাজেট’-এর আকার বাড়ানো হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে জেন্ডার সম্পৃক্ত বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ২৯ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা এবং চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩২ হাজার ১১০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। অর্থাৎ মোট বাজেটের ৩৪.৩৭% টাকা নারী উন্নয়নে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নারী উন্নয়ন ও জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণের জন্য সরকারের ৪৪ টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর অনুকূলে এ বরাদ্দ দেওয়া হয়। (তথ্যসূত্র : বণিকবার্তা, ১৩ জুন ২০২৩, এবং জাতীয় বাজেট বক্তৃতা ২০২৩-২৪)
উপরের তথ্যগুলো পড়ার পর নারীদের নিয়ে একটু-আধটু ভাবেন এমন যে কারোরই মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। আমারও হয়েছিল। কিন্তু ‘জেন্ডার বাজেট’ নিয়ে বিস্তারিত জানতে পত্রিকা ঘাটাঘাটি করে বেশ কয়েকটি লেখা, মতামত পড়ার পর মনটা চুপসে গেল। ‘জেন্ডার সমতাভিত্তিক সমাজ ও নারীর ক্ষমতায়ন’ শিরোনামে প্রতিবছর বৈশ্বিক লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সরকারের বাজেটে নারীর জন্য কতটা বরাদ্দ রাখা হয় এবং নারীর সার্বিক উন্নয়নে কী কী পদক্ষেপ যুক্ত করা হয়েছে, তা নির্ধারণ করে সরকার কতটা নারী-বান্ধব এবং সরকারের কার্যক্রম কতোটা জেন্ডার রেসপন্সিভ, তার একটা আমলনামা হলো এই প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশ ১৪৬ টি দেশের মধ্যে ৭১ তম হয়েছিল। (তথ্যসূত্র : জাতীয় বাজেট বক্তৃতা ২০২৩-২৪, পৃষ্ঠা নম্বর ৭৮) মূলত এই জন্যই বাজেটে ‘জেন্ডার বাজেট’ নামে গালভরা বিরাট অঙ্কের বরাদ্দ দেখিয়ে দেওয়া হয়। সুনির্দিষ্ট তেমন কোন প্রকল্প, লক্ষ্য, পরিকল্পনা, কর্মসূচি থাকে না সেজন্য। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন :
“জেন্ডার বাজেট থাকায় লিঙ্গসমতার বিষয়টি আলোচনায় থাকে। এটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এতদিন ধরে চলে আসা জেন্ডার বাজেটে নিঃসন্দেহে কিছু বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। তবে আমরা যদি লিঙ্গসমতা চাই, তাহলে এটিকে মূলধারায় নিয়ে এসে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি কাজের মূল্যায়ন করতে হবে।”
অর্থাৎ স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের অভিপ্রায়ে দেওয়া ২০২৩-২০২৪ সালের ‘স্মার্ট’ বাজেটের পাতায় জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট এবং স্মার্ট কোন কিছুরই উল্লেখ নেই। নারীর কর্ম-পরিবেশ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণ, প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে টুকটাক নামকাওয়াস্তে, লোকদেখানো কিছু কর্মসূচি আছে অবশ্য। অথচ স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট সোসাইটি গড়ে তুলবে যে স্মার্ট সিটিজেন, তাদের প্রায় অর্ধেক সিটিজেন নারীর অবস্থান সোসাইটির যে স্তরে পড়ে আছে, সেখান থেকে তাদের উঠিয়ে নিয়ে আসতে যেরকম নীতিমালা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন, সেসবের কোন উপস্থিতি নেই জেন্ডার বাজেটে। এখন আসুন, বর্তমান সমাজে, পরিবারে নারীদের অবস্থান কোথায়, সে সম্পর্কে কতগুলো কেইস স্টাডি আপনাদের সামনে উপস্থাপন করি।
কেইস স্টাডি : ১
হাজেরা খাতুন একজন আশির্ধ্বো বয়স্কা মহিলা। উনার পাঁচ মেয়ে, দুই ছেলে। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি স্বামীর সাথে স্বামীর বাড়িতে দুই পুত্র ও পুত্রবধূ সমেত বসবাস করছেন। হাজেরা খাতুনরা দুই ভাই ও এক বোন। উনার পিতা ও মাতা ইন্তেকাল করেছেন বহু বছর পূর্বে। এখন উনার পিতার দুই কোটি টাকার সম্পদ হতে আট লক্ষ টাকা উনাকে সেটেলমেন্ট হিসেবে অফার করা হচ্ছে। অথচ উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী উনার পাওয়ার কথা ছিল এক কোটি টাকা। এখন উনার ছেলেমেয়েরা মনে করছেন, মামলায় গেলে হয়তো টাকা বেশি পাওয়া যাবে, কিন্তু ঝামেলাও হবে বিস্তর। এবং মামার বাড়ির সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক তিক্ততায় চলে যাবে। হয়তো সারাজীবনের জন্য সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে। তাই উনারা দশ লাখ টাকায় সেটেল করতে রাজি আছেন।
কেইস স্টাডি : ২
নাফিদা আহমেদ একজন পিতা-মাতাহীন ডিভোর্সি প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা। উনার এক মেয়ে ও এক বড় ভাই রয়েছে। আফটার ডিভোর্স, উনি যখন উনার বাবার বাড়িতে উঠতে যান, তখন উনাকে ভাইয়ের বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। এমনকি ডিভোর্সি বলে উনার চরিত্রের উপর কালিমা লেপনের চেষ্টায় গুজব রটানো হয়। এসবের ভেতর টিকতে না পেরে উনি শহরে এক বাসা বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে ভাড়া থাকতে বাধ্য হন।
কেইস স্টাডি : ৩
সালমা বেগমরা ৪ বোন ১ ভাই। পৌরসভার মধ্যে প্রায় ৪০ বিঘা জমি রেখে মারা যান সালমা বেগমের পিতা আব্দুল হাই মুন্সি। পিতার মৃত্যুর পর একমাত্র ভাই বিভিন্ন উছিলা দিয়ে নামমাত্র মূল্যে একের পর এক জমি বিক্রি করতে থাকেন। এক সময় নিজের সম্পত্তি বিক্রি শেষ করে বোনদের সম্পত্তিতে হাত পড়ে তার। তখন সালমা বেগমের স্বামী স্ত্রীর গুণধর ভাইকে অবশিষ্ট সম্পত্তি যে বোনদের, সে কথা কেবল স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়েছিলেন। ব্যস, এইটুকুই। এরপর জমি বিক্রিতে বাধা দিতে যাননি কখনো। ফলাফল হলো, সালমা বেগম অসুস্থ হয়ে কয়েক বছর ঘরবন্দী ছিলেন। বারবার খবর দেওয়ার পরও ভাই একটিবারের জন্যও বোনকে দেখতে আসেনি। এমনকি মৃত্যুর পরেও না।
কেইস স্টাডি : ৪
বেবি সরকার। বাবার বাড়ি চট্টগ্রামে। বিয়ে দেওয়া হয় মদখোর, গাঁজাখোর এক পাত্রের সাথে। বিয়ের পর যৌতুকের জন্য স্বামী ও তার বাড়ির লোকজন নানাভাবে অত্যাচার করতো। শত অত্যাচার সহ্য করে হলেও স্বামীর বাড়িতে থেকে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে সন্তানসহ বাড়ি থেকে বের করে দেয় বেবি সরকারকে। পৈতৃক সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার না থাকায় স্বামীগৃহ থেকে বিতাড়িত বোনকে দাদা-বৌদিও আশ্রয় দেননি। নিরুপায় হয়ে তিনি চট্টগ্রাম শহরে এসে কারখানায় কাজ নেন। কয়েক বছর পর ক্যান্সার ধরা পড়ায় অসুস্থ বেবি সরকার কাজ হারিয়ে ভিক্ষার পথ বেছে নেন।
জেন্ডার ডিস্ক্রিমিনেশনের প্রথম এবং প্রধান উৎসই হলো পিতার সম্পত্তিতে কন্যা সন্তানের উত্তরাধিকারহীনতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অর্ধেক উত্তরাধিকার। শুধুমাত্র লৈঙ্গিক কারণে পুরুষ জন্মমাত্রই ক্ষেত্রবিশেষে লাখ কিংবা কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়ে যায়। অথচ বৈধ উপায়ে একই পরিমাণ সম্পত্তির প্রকৃত মালিক হতে একই পরিবারে জন্ম নেওয়া একজন মেয়েকে সারা জীবনের কঠোর শ্রম, মেধা, অধ্যবসায় বিনিয়োগ করতে হয়। ২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিলে প্রকাশিত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৯৬% জমির মালিকানা পুরুষের আর মাত্র ৪%-এর মালিকানা নারীর। অথচ রাইটস অফ ফাদার’স প্রোপার্টির বেলায় সরকার একেবারে নিশ্চুপ। তাহলে কি এভাবেই হাওয়ার মধ্যে ২০৪১ সালের মধ্যে সুখী-সমৃদ্ধ-উন্নত-স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ হবে?
তথ্যবহুল লেখা
চমৎকার গোছানো একটা লেখা। লেখক অনেক গবেষণা করেছেন। ধন্যবাদ