শনিবার, জুলাই ২৭, ২০২৪
Homeশিক্ষা সমাচারশাটল ট্রেন : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ

শাটল ট্রেন : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সবচেয়ে বড় এবং পাহাড়ে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি ক্যাম্পাস। শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়। শহর থেকে ক্যাম্পাসের দূরত্ব বেশি হওয়ায় শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে খুব কষ্ট হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ কমানোর উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রেল মন্ত্রণালয়ের সাথে চুক্তির মাধ্যমে ক্যাম্পাসে যাতায়াতের জন্য শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা করে৷ বতর্মান বিশ্বে একমাত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই শাটল ট্রেন ব্যবস্থা চালু আছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে শাটল ট্রেন যুক্ত হয়ে, অনন্য সৌন্দর্যময় করে তুলেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে। শিক্ষার্থীদের কতো যে আবেগ, ভালোবাসা জড়িয়ে আছে এই শাটল ট্রেনে! সৃষ্টি হয়েছে কত প্রেমকাহিনী! শাটল নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান ও কবিতা! নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রও!

রেল মন্ত্রণালয়ের সাথে চুক্তির মাধ্যমে ১৯৮১ সালে ১০ টি বগি নিয়ে শাটল ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়। এর জন্য প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়া প্রদান করা হয় রেল মন্ত্রণালয়কে৷ ২০২৩ সালে এসেও যাত্রা শুরুর লগ্নের ১০ টি বগি নিয়েই চলছে শাটল। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ১ জুলাই রেল মন্ত্রণালয়ের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চুক্তি হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী শাটল ট্রেনের বগির সংখ্যা বৃদ্ধি করে ১৪ টি দেওয়ার কথা। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই চুক্তির বাস্তবায়ন করা হয়নি। বরং মাঝে মধ্যে দেখা যায় ৬/৭/৮ টি বগি নিয়ে শাটল যাতায়াত করে৷ শাটলের বগি বৃদ্ধি না করা হলেও বিভিন্ন মেয়াদে শাটলের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে৷ বর্তমানে প্রতিমাসে রেল মন্ত্রণালয়কে শাটল ব্যবহার বাবদ ৯ লক্ষ ৩ হাজার টাকা প্রদান করা হয়, যা শুরু হয়েছিল ১০ হাজার টাকা দিয়ে৷ যদিও বলা হয়, শাটল ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে চালানো হয় না!

প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শাটলের ভাড়া বাবদ প্রতিবছর ৫৭৯ টাকা করে নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটেও বরাদ্দ আছে ০.৪৯ শতাংশ টাকা। এরপরও শাটলে যাতায়াতে দিনদিন বেড়ে চলছে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি। সীমিত সিট সংখ্যা, চুরি-ছিনতাই, যৌন হেনস্তা, পাথর নিক্ষেপ ইত্যাদি কারণে প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। বিশেষ করে, অপর্যাপ্ত সিট দুর্ভোগের প্রধান কারণ। প্রত্যেক শিক্ষার্থী শাটল বাবদ ফি প্রদান করা সত্ত্বেও তাদের সিটের নিশ্চয়তা নেই। বর্তমানে সিট তো দূর কি বাত, গাদাগাদি করে যাতায়াত করতে হয়৷ পা ফেলার তিল পরিমাণ জায়গাটুকু পর্যন্ত থাকে না৷ এসব সমস্যার ভিড়ে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে শাটল ট্রেনের সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য। গান-বাজনা, হাসি-আড্ডায় মুখরিত শাটলের দৃশ্য খুব কমই চোখে পড়ে এখন।

এছাড়াও ক্যাম্পাসে রয়েছে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের একাধিক গ্রুপের দাপট। এদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও ঝামেলা সৃষ্টি হলে শাটল শিডিউল মতো যাতায়াত করে না। এর জন্যও দুর্ভোগ পোহাতে হয় শিক্ষার্থীদের।

পুরো দেশ ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আসার কথা বলা হলেও আজ পর্যন্ত শাটলে কোন নতুনত্ব যোগ  হয়নি। সেই পুরোনো ব্রিটিশ আমলের ফিটনেসবিহীন ইঞ্জিন দিয়েই চলাচল করে শাটল৷ নেই ফ্যান, রাতের শাটলে নেই লাইট, নেই বাথরুমের ব্যবস্থা। এক জীর্ণশীর্ণ অবস্থা শাটলের৷

এতোশত সমস্যা, শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ আর অদৃশ্য এক মায়ার ভেতর দিয়েই চলছে শাটল। সমস্যা সমাধানে নেই প্রশাসনের কোন আগ্রহ। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন করে আসছে৷ সিট সংকটের কারণে প্রতিদিন অনেক শিক্ষার্থী ট্রেনের ছাদে উঠে যাতায়াত করে, যা বিপজ্জনক এবং আইন বিরোধী। গত ৭ সেপ্টেম্বর শাটলের ছাদে থাকা শিক্ষার্থীরা মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হয়। ২০ জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। এরমধ্যে ৪ জনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল৷ এর আগেও বিভিন্ন দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনার বেশ কয়েক মাস আগে শাটলের ছাদ থেকে নামার সময় এক শিক্ষার্থী নিহত হয়।

৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর পুরো ক্যাম্পাস আন্দোলনে ফেটে পড়ে৷ এতো বড় দুর্ঘটনার পরও এখনো সমস্যা সমাধানের কোন পদক্ষেপ নেই। সমস্যার সমাধান ও দাবি-দাওয়া পূরণের জন্য গণস্বাক্ষর নিয়ে প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। প্রশাসন ৩ দিন সময় নিয়েছিল। ৩ দিন সেই কবে পার হয়ে গিয়েছে! আজো স্মারকলিপির কোন জবাব কিংবা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থার আভাস পায়নি শিক্ষার্থীরা।

৭ সেপ্টেম্বর রাতের আন্দোলনে বিক্ষিপ্ত কিছু ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। একে কেন্দ্র করে প্রশাসন ২ টি মামলায় ১,০০০ শিক্ষার্থীর নামে অজ্ঞাত মামলা দায়ের করে, যা শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে৷ ধারণা করা হয়, ষড়যন্ত্রকারী এবং প্রশাসনের দালালেরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিভাবক হয়ে কীভাবে শিক্ষার্থীদের উপর এইভাবে মামলা দিতে পারলো?  হাজারো সমস্যার সমাধান না করে শিক্ষার্থীদেরই দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে! কী শিখবে আর জাতিকে ভবিষ্যতে কী দেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই শাটল। সময় মতো ক্লাশ-পরীক্ষায় উপস্থিত হওয়া এই শাটলের উপর নির্ভর করে। শাটলে যাতায়াত করে অনেক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস থেকে শহরে গিয়ে টিউশন করিয়ে তাদের সারা মাসের হাত খরচের টাকা যোগায়, শিক্ষার ব্যয় বহন করে।

“In a bubble filled with color there is no regret in one’s mind and mind lives in the color fair to life.”

সত্যিই এই রঙের ভুবনে কারো দুঃখ থাকতে নেই। কিন্তু এরপরও দুঃখরা চলে আসে, এই অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা শিক্ষার্থীদের মাঝে৷ আর কতো শিক্ষার্থীর রক্ত ঝরলে শাটলকে ঘিরে এই সকল সমস্যার অবসান হবে? শাটলকে ঘিরে সকল স্মৃতি আজীবন অম্লান হয়ে থাকবে শিক্ষার্থীদের মনে। কিন্তু নেতিবাচক স্মৃতিগুলো ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে?


তথ্যসূত্র
১. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাজেট ২০২২-২৩ ও
২. কালের কণ্ঠ, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪


স্থিরচিত্র
চবিয়ান পেইজ থেকে

আরো পড়ুন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাম্প্রতিকা