শনিবার, ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪
Homeমেলাঘরবইবাহিক: সঙ্গ ও নি:সঙ্গতার এক অপরূপ আখ্যান

বইবাহিক: সঙ্গ ও নি:সঙ্গতার এক অপরূপ আখ্যান

এই বইটার পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে একটা গন্ধ। নিঃসঙ্গতার গন্ধ। গল্প এমন আহামরি কিছু নয়; অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করতে যাওয়া জেবুন্নিসা নাম্নী এক বাংলাদেশী মুসলামান তরুণীর একটি দিনের গল্প। ওই একটা দিনে যেসব ঘটনা ঘটে, ঘটনা হিসেবে সেসব খুবই মামুলি। কিন্তু এক নিঃসঙ্গ ও সংবেদনশীল মন নিয়ে জেবুন্নিসা যখন ঘটনাগুলোর সম্মুখীন হয়, তখন ঘটনাগুলো তাদের মামুলিত্ব হারিয়ে ফেলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফুটপাতে হেঁটে যাওয়া, ট্রামে ওঠা, হেমন্ত কুমারের গান, অরুন্ধতীর উপন্যাস, দূর থেকে দেখা মানুষ, ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট, জানালার ভেতর দিয়ে দেখা আকাশ, মেঘ আর পাখি- এই সবই জেবুন্নিসার জীবনের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ঘটনা।

এরকমই আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো স্মৃতিচারণ। স্মৃতিচারণের ভেতর দিয়েই আমরা জেবুন্নিসার সঙ্গে তারেকের প্রেমের গল্পটা আদ্যোপান্ত শুনি। শুনি তার আরো অনেক গল্প। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জেবুন্নিসা এমন এক মন-কেমন-করা ভাষায় নিজের অতীত ও বর্তমানের কথা বলে যে, উপন্যাসের মিলনাত্মক পরিসমাপ্তি এবং জায়গায় জায়গায় হিউমারের উপস্থিতি সত্ত্বেও যে বিষণ্ন সুর পুরো গল্পকে জড়িয়ে আছে, সেই সুরটা কিছুতেই কাটতে চায় না। অবশ্য এটা পাঠক হিসেবে আমার সীমাবদ্ধতাও হতে পারে। আমিই হয়তো ওই বিষণ্ন সুরটা ভালোবেসে ফেলেছি। যে কারণে বের হয়ে আসতে পারছি না কিছুতেই। হাজার হোক, জেবুন্নিসার বয়স তো ২৫, মানে আমারই সমবয়সী বলা যায়। যে কারণেই হোক, এই চরিত্রটাকে খুব বিশ্বস্ত ও আপন মনে হচ্ছে আমার। ফলে আমি হয়তো আমার নিজের বিষণ্নতার মধ্য দিয়েই চরিত্রটাকে বোঝার চেষ্টা করছি (এটাও কিন্তু জেবুন্নিসার একটা বৈশিষ্ট্য); হয়তো নিজের নিঃসঙ্গতার আভাস পাচ্ছি বলেই জেবুন্নিসাকে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে আমার। কারণ নিঃসঙ্গতার গন্ধ আমি চিনি। একটা পিঁপড়ে যেভাবে তার আপন গোত্রের পিঁপড়েকে চিনতে পারে, ঠিক সেইভাবে। নিঃসঙ্গ মানুষের একটা স্বভাবই হচ্ছে, সে প্রকৃতির মধ্যে, বহমান ঘটনাস্রোতের মধ্যে সঙ্গ ও নিঃসঙ্গতা উভয়ই আবিষ্কার করে নিতে পারে।

এই উপন্যাসের আরেকটা শক্তির জায়গা হচ্ছে এর ভাষা। ঢাকাইয়া কথ্য ভাষায় এখন অনেকেই গল্প-উপন্যাস লিখছেন। কিন্তু তাদের অনেকেই ভাষার রাজনীতি যতোটা করেন, সাহিত্যসৃষ্টি ততোটা করেন বা করতে চান বলে মনে হয় না। তাদের ভাষা-রাজনীতির চোটে স্বতঃস্ফূর্ততা জিনিসটাও প্রায় হারিয়ে যায়, এক কৃত্রিমতার জায়গায় দেখা দেয় আরেক কৃত্রিমতা। সৌভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, ‘বইবাহিক’ এই দোষ থেকে মুক্ত। জেবুন্নিসা যেহেতু উত্তম পুরুষে নিজের কথা বলছে, সেহেতু ন্যারেশনে ঢাকাইয়া ভাষার ব্যবহারটা খুব মানিয়ে গেছে এক্ষেত্রে। ঢাকা শহরের কোনো ২৫ বছর বয়স্কা তরুণী ঠিক এই ভাষায়ই তার অন্তরের কথা বলে, ঠিক এই ভাষায়ই সে যোগাযোগ গড়ে তোলে বাহ্য-পৃথিবীর সঙ্গে। প্রমিত ভাষা এখানে অচল। কথ্য ভাষার সুনিপুণ ব্যবহারই পুরো গল্পটাকে এতো বিশ্বাসযোগ্য ও আন্তরিক করে তুলেছে।

তবে এই জেবুন্নিসা চরিত্রটি এতো জীবন্ত হতে পারতো না, যদি লেখক তার সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিবেশটা ঠিকমতো না আঁকতেন। জেবুন্নিসা এমন একটা সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে গিয়েছে, যখন সারা বিশ্বে ( বিশেষ করে পাশ্চাত্যে ) মুসলমানরা নিছক মুসলমান হবার কারণেই রাজনৈতিক ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার শিকার। ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে মুসলমানদের উপর হামলা এবং পার্শ্ববর্তী দেশ অস্ট্রেলিয়ায় সেই হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে মুসলমানদের দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহারের প্রচেষ্টা, স্বল্প পরিসরে হলেও সবই উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। ঠিক এইরকম একটা সময়ে একজন প্রবাসী মুসলমান নারী হিসেবে পাশ্চাত্যে বসবাস করা সম্ববত কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। কারণ এক ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক টানাপোড়েনের মধ্যে সবসময়ই ঘুরপাক খেতে হয় জেবুন্নিসাকে। জেবুন্নিসা গভীরভাবে বিশ্বাসী একজন মানুষ, যদিও জীবনাচরণে অনেকটাই অধার্মিক। তার ধর্মীয় বিশ্বাস তাকে সারা বিশ্বের মুসলমানদের সঙ্গে এক ধরনের যৌথতার বোধ এনে দেয় ঠিকই, কিন্তু এই যৌথতার বোধ তার অনিরাপত্তাকে কমাতে পারে না।

এদিকে জেবুন্নিসার জন্মভূমি বাংলাদেশও ওই সময়ে ভয় আর অনিরাপত্তার একটা বিরাট কারখানা হয়ে উঠেছে। নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যার ঘটনা উঠে এসেছে, আমরা দেখতে পাই, ত্বকীর মায়ের কথা ভেবে কাতর হচ্ছে জেবুন্নিসা৷ এই যে দেশ এবং বিদেশ, কোনোটাকেই নিজের বলে ভাবতে না পারা, এইটা একজন মানুষকে চরম এক মানসিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। এবং এটাই আমরা ঘটতে দেখি জেবুন্নিসার ক্ষেত্রে। জেবুন্নিসা তীব্র প্রেম আর যৌথতার বোধ সত্ত্বেও, তার পরিচয়ের প্রতিটা স্তরেই নিঃসঙ্গ ও অসহায়। বাংলাদেশী হিসেবে সে অসহায়, মুসলমান হিসেবে সে অসহায়, প্রবাসী মুসলমান হিসেবে সে অসহায় এবং সর্বোপরি সে অসহায় মানুষ হিসেবে। এই অসহায়ত্ব অবশ্য কোনো আপতিক বা ব্যক্তিগত ব্যাপার না। আধুনিক রাষ্ট্র ও রাজনীতির একটা প্রধান কাজই হচ্ছে ব্যক্তি ও সমষ্টির এই অসহায়ত্ব উৎপাদন করে যাওয়া।

সব মিলিয়ে একটা দারুণ কাজ। ‘বইবাহিক’-কে আমার কাছে মনে হয়েছে যুগপৎ সঙ্গ ও নিঃসঙ্গতার এক দারুণ আখ্যান। গল্পটা আরো বড়ো হলে হয়তো ভালো হতো, কিন্তু এরপরও অন্তত জেবুন্নিসা চরিত্রটার জন্য হলেও এই উপন্যাসের অনেক সীমাবদ্ধতাই ঢাকা পড়ে যায়। এমন একটা চরিত্র সৃষ্টির জন্য লুনা রুশদী ধন্যবাদ পেতেই পারেন।

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সাম্প্রতিকা